টানা বৃষ্টিতে পূর্ব বর্ধমানের ১৫০ গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত, সিভিল ডিফেন্সের তৎপরতায় উদ্ধার ৪, পুলিশের তৎপরতায় উদ্ধার একটি পরিবার
admin
বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- দু’দিনের একটানা বৃষ্টি তার সঙ্গে ডিভিসির ছাড়া জলে পূর্ব বর্ধমান জেলার একাধিক এলাকা প্লাবিত হল। কোনো হতাহতের খবর না থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন একাধিক পরিবার। দু’দিনের ভারী বৃষ্টির জমা জলের পর ডিভিসির জল ছাড়ায় জলমগ্ন হয়েছে কালনার মন্তেশ্বর ব্লকের মাঝেরগ্রাম পঞ্চায়েত আমাটিয়া, বসতপুর, গাব্রুপুর, ভান্ডারবাটি, পিয়াগ্ৰাম, দেওয়ানগাদি ও ভেলিয়া গ্রাম। নতুন করে জলে তলিয়ে গেছে বিঘার পর বিঘা জমির ফসল, যত সময় গড়াচ্ছে ততই আতঙ্ক বাড়ছে গ্রামবাসীদের। গতকাল সকাল থেকে আজ পর্যন্ত লাগাতার বৃষ্টি এবং তার ওপর ডিভিসির জল ছাড়ায় মাঝের গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঁকা নদীর জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় সেই জল ঢুকে মাঝের গ্রাম অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় জলমগ্ন হয়েছে। এই এলাকায় আমন ধানের জমি জলের তলায়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শাকসবজির জমিতে জল ঢুকে ক্ষতির মুখে চাষীরা। এরই পাশাপাশি লাগাতার বৃষ্টির জেরে বর্ধমান শহরের একাধিক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বর্ধমান শহরের ১, ৩, ৪, ৭, ১৩, ১৪ ও ১৯ ওয়ার্ডের কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। রায়ান গ্রাম পঞ্চায়েতের ডাঙ্গাপাড়া, বিদ্যাসাগরপল্লী, মালির বাগান-সহ একাধিক এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। অন্যদিকে, নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামকে জলমগ্নের হাত থেকে বাঁচাতে পাটনা গ্রাম ও মুরাতিপুর গ্রামের কাছে রাস্তা কেটে দিলেন গ্রামবাসীরা। রাস্তা কাটার ফলে ভাতারের বলগোনা-গুসকরা রাস্তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। গ্রামের জল না কমলে এই রাস্তা মেরামতি হবে না বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। এদিকে, বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে খড়ি নদী। জলের তোড়ে যেকোনো মুহূর্তে ভেসে যেতে পারে মাছ ধরার নৌকা এই আশঙ্কায় জীবন-জীবিকা রক্ষার তাগিদে বিপদকে উপেক্ষা করেই ডিঙি নৌকা আনতে জলে নামেন ভাতারের পারহাট দাসপাড়ার বাসিন্দা ফড়িং দাস ও কর্ণধর দাস। কিন্তু জলের তোড়ে নৌকা তো দূর অস্ত নিজেরাই খড়খুটোর মতো ভেসে যেতে শুরু করেন। প্রাণ বাঁচাতে কোনো রকমে দু’জনই আশ্রয় নেন গাছে। দীর্ঘক্ষণ গাছে আটকে দুজনে যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন তখন নদীতে আরও জল বাড়ছে দেখে তাঁদের উদ্ধার করতে যান গ্রামেরই উত্তম দাস ও শ্রীকান্ত দাস নামে আরও দুজন। কিন্তু তারাও কার্যত অপরাগ হয়ে একই গাছে তাঁরাও আশ্রয় নেন। দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার পর স্থানীয়দের নজরে বিষয়টি আসতেই তাঁরা ভাতার থানার পুলিশকে খবর দেন। ভাতার থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিপর্যয় ব্যবস্থাপন দপ্তরকে খবর দিলে বর্ধমান থেকে সিভিল ডিফেন্সের কর্মী শিবু গুহ, সুমন্ত কোলে, রাজু মণ্ডল, রাখাল হেমব্রম, কার্তিক পাল, উত্তম ঘোষ প্রমুখ ৮ জনের একটি দল পৌঁছায় গ্রামে। তাঁদের সহযোগিতায় চারজনকেই নিরাপদে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়। অন্যদিকে, মেমারীর গন্তার খাসপাড়ায় আটকে পরা আদিবাসী পরিবারকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। মাঝ রাতে সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে পরিবারটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে মেমারী থানার পুলিশ। এরই পাশাপাশি আউশগ্রামের ভেদিয়া আণ্ডারপাশ জলমগ্ন হওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। একাধিক রাস্তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বর্ধমানের পালিতপুরের আন্ডারপাস, বর্ধমানের কালনা রেলগেটের আন্ডারপাস ও রায়নগর রেলব্রিজের তলা জলমগ্ন হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। পালিতপুর রেল আন্ডার ব্রিজ জলমগ্ন হওয়ায় যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। এই রেল আন্ডার ব্রিজে জমা জলে ডুবে যায় একটি সাবান বোঝাই গাড়ি। ৬নং ওয়ার্ডের তৃণমূল নেতা শিবশংকর ঘোষ জানিয়েছেন, দুর্গত এলাকায় এদিন সকাল থেকে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে তাঁরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন। বর্ধমানের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রাত জেগে জনপ্রতিনিধিরা এলাকায় ঘুরে দেখেছেন সামগ্রিক পরিস্থিতি। এদিকে, এব্যাপারে এদিন জেলা বিপর্যয় ব্যবস্থাপন আধিকারিক প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পূর্ব বর্ধমান জেলার ১২ টি ব্লক এবং ২ টি পৌরসভা বর্ধমান ও গুসকরা পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট ১৫০ টি গ্রাম এবং ১৫ টি ওয়ার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১১৬০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। তিনি জানিয়েছেন, ৪১০ টি আংশিক বাড়ি এবং ৭২ টা সম্পূর্ণ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনও মৃত্যু বা গুরুতর জখম হওয়ার খবর নেই। এখনও পর্যন্ত অস্থায়ী ক্যাম্প করতে হয়নি। গত দুদিনে জেলায় বৃষ্টি হয়েছে ২০২.৫ মিলিমিটার। তিনি জানিয়েছেন, রবিবার পর্যন্ত এই জেলায় কোনো সতর্কবার্তা নেই। জেলাশাসক কে রাধিকা আইয়ার জানিয়েছেন, বেশ কিছু এলাকা থেকে গ্রামবাসীদের উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জামালপুর, কালনা, কাটোয়া, গলসী, বর্ধমান-সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ক্ষতি হয়েছে। জেলা বিপর্যয় ব্যবস্থাপন দপ্তর এবং অন্যান্য জরুরি বিভাগকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে জেলা স্তরের কন্ট্রোলরুম। যার নম্বর 8001192740। অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) অমিয় মণ্ডল জানিয়েছেন, প্রবল বর্ষণের কারণে বেশ কিছু জায়গায় কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কাটোয়া ১ – ২, মঙ্গলকোট, বর্ধমান ১- ২, গলসী ১, ভাতার, আউশগ্রাম ২, রায়না ১ ও ২, জামালপুর এবং মেমারী ২ ব্লকের মোট ৭৭ টা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ১৫০ গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ হিসাব এখনও আসেনি। ৩৪ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা বাড়ির ক্ষতি হয়েছে। প্রতি মহকুমার পর্যাপ্ত রিলিফ সামগ্রী পাঠানো হয়েছে।