E Purba Bardhaman

স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে প্রতিষ্ঠিত বর্ধমানের ‘অনাদি বেকারি’ আজও শীতের মরশুমে নিরামিষ কেক তৈরী করে চলেছে

Anadi Bakery, established in Burdwan in 1939, is still in demand for eggless veg cakes

বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- বড়দিন মানেই যেখানে কেক, সেখানে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে তৈরী হওয়া বর্ধমানের ‘অনাদি বেকারি’-র নিরামিষ কেকের চাহিদা আজও অমলীন বর্ধমান শহরে। নয়নয় করে ৮৩ বছর অতিক্রান্ত করতে চলেছে এই বেকারি। যার খ্যাতি শুধু বর্ধমান শহরই নয়, প্রতিবেশী বাংলাদেশেও এখন নিরামিষ কেক বলতে বর্ধমানের এই অনাদি বেকারির নামই জ্বলজ্বল করছে। ১৮৩৯ সালে দেশের স্বাধীনতার আগে তৈরী হয় বর্ধমান শহরের রাণীসায়র উত্তরপাড়ে এই অনাদি বেকারি। এই বেকারীর প্রতিষ্ঠাতা অনাদিনাথ বন্দোপাধ্যায়ের নাতি এবং বর্তমান মালিক রুদ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ১৯৩৯ সালে ঠাকুরদা অনাদিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। ১৯৪০ সালে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া যায়। ব্রিটিশ রাজত্বে বেকারি নিয়ে পড়াশোনা করে এই ব্যবসা শুরু করেছেন। তখন এই বিষয়ে পড়াশোনা না করলে লাইসেন্স পাওয়া যেত না। অনাদিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে রেলের চাকরি পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করে ভবানীপুরে বেকারি নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন। ১ বছরের পাঠ্যক্রম শেষে মেজ দাদা তারকনাথ বন্দোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় বর্ধমান শহরের রানিসায়র উত্তর পাড়ে চালু হ’ল অনাদি বেকারি। একসময় অনাদি বেকারি থেকে রেলের ক্যান্টিনে খাবার সরবরাহ করা হত। স্বাধীনতার পরও তা চালু ছিল। বর্ধমান হাসপাতাল এবং বেশ কয়েকটি স্কুলে পাউরুটিও যেত এই বেকারি থেকে। ১৯৮০ সালে অনাদিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যুর পর রাজ কলেজ থেকে স্নাতক স্কুলে শিক্ষকতার কাজে যুক্ত বড় ছেলে হরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যবসার হাল ধরলেন। অপর দুই ছেলে দ্বারকানাথ ও লোকনাথ তখনও স্কুলে পড়েন। পরবর্তী সময়ে অনাদিনাথবাবুর ৩ ছেলেই ব্যবসার দায়িত্ব নেন। গত বছর করোনায় অনাদিনাথবাবুর ২ ছেলের মৃত্যুর পর মেজ ছেলে দ্বারকানাথের সাথে অনাদিনাথের নাতি রুদ্রনাথ বন্দোপাদ্যায় ব্যবসার হাল ধরেন। রুদ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কম্পিউটার সাইন্সে পি এইচ ডি করেছেন। চাকরী না করে যোগ দিয়েছেন পারিবারিক ব্যবসায়। রুদ্রনাথবাবু জানিয়েছেন, এই বেকারীর উৎপাদিত দ্রব্যের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা হয়। সেটা দীর্ঘ বছর ধরেই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। পুরনো মাল বিক্রি করা হয়না। যেটুকু ক্ষমতা সেটুকু তৈরী হয়, প্রতিদিন সেটুকুই বিক্রি হয়। অনেক বড় বড় কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও তাই অনেকেই দূরদূরান্ত থেকেও তাঁদের কাছে আসেন। তাঁরা জানেন, এখান থেকে টাটকা এবং ভালো মানের মাল পাবেন। তিনি জানিয়েছেন, বিভিন্ন কারণে নিরামিষাশী মানুষজন অথবা অনেকেরই ডিমে অ্যালার্জি বা শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে ডিম খান না তাঁদের ভরসার জায়গা এই দোকান। বর্ধমানের অনেক বাসিন্দা অন্য জেলা বা বাংলাদেশে বসবাসকারী আত্মীয়স্বজনদের প্রতি বছর এখান থেকে কেক কিনে পাঠান। রুদ্রনাথবাবু জানিয়েছেন, উৎপাদনের থেকে চাহিদা অনেক বেশি বলে আগে বুকিং করতে হয়। তবে বুকিং-এর সময় অগ্রিম কোনও টাকা দিতে হয়না। প্রোডাক্ট নিয়ে তাঁরা এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে যিনি অর্ডার করবেন তিনি আসবেনই -এবিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত। আর কোনও বিশেষ কারণে কেও অর্ডার দিয়ে নাও আসতে পারলে সেটা ওই দিনই বিক্রি হয়ে যায়। তিনি জানিয়েছেন, বর্তমানে তিনি এবং বড় কাকা দ্বারকানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠানটি থেকে যাতে দীর্ঘমেয়াদী ভাবে ক্রেতাদের পরিষেবা দিতে পারা যায় সেজন্য নতুনভাবে পরিকাঠামো এবং কোয়ালিটির দিক থেকে সবরকম উন্নতির চেষ্টা করছেন। কেক সারা বছর তৈরী হয়না। বছরের অন্যান্য সময়গুলিতে নানখাটাই বিস্কুট, পাউরুটি, ফরাসি পাউরুটি, স্পেশাল লেরুয়া এগুলো তৈরী হয়। কেকের মরশুমে এগুলো প্রায় ১ মাস তৈরী বন্ধ থাকে। পুরনো দিনের বেকারীর সাথে আধুনিক প্রযুক্তির মিশ্রণ করে বর্ধমানে একটা ক্যাফে চালু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রুদ্রনাথ। তিনি জানিয়েছেন, এটা হবে পুরো নিরামিষ ক্যাফে। বেকারি প্রোডাক্টের সঙ্গে কুকিস, কেক, পেস্ট্রি-সহ সবই নিরামিষ পাওয়া যাবে আগামী দিনে এই ক্যাফেতে। রুদ্রনাথবাবু জানিয়েছেন,  ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রচুর চাহিদা থাকলেও শীতের মরশুম জুড়ে প্রায় ৩ মাস ধরেই কেক তৈরী হয়। প্রতিদিন প্রায় গড়ে ২০০ পাউন্ড করে বিক্রি হয়। ২৩-২৬ ডিসেম্বর প্রতিদিন প্রায় ৩০০ পাউন্ড বিক্রি হয়। চাহিদা থাকলেও উৎপাদন বাড়ানোর সেরকম পরিকাঠামো না থাকায় কিছুই করার নেই। তাই কয়েকদিন আগে থেকেই হোয়াটসঅ্যাপ, ফোনে অর্ডার দিতে হয় – তবেই মেলে এই কেক। এরই পাশাপাশি কয়েকদিন আগে দোকানে এসে অর্ডার দিয়ে টোকেন নিয়ে যেতে হয়। নির্ধারিত দিনে টোকেন দেখিয়ে পাওয়া যায় পছন্দের এই কেক। এখনও কাঠের চুল্লিতেই কাজ হচ্ছে। এর স্বাদ আলাদা। তিনি জানিয়েছেন, কোনও বিশেষ কারণে কেউ অর্ডার দিয়ে নাও আসতে পারলে সেটা ওই দিনই বিক্রি হয়ে যায়। রুদ্রনাথবাবু জানিয়েছেন, গত বছর থেকে সুগার ফ্রি কেক তৈরী হচ্ছে। এখানে ৫০-২৫০ টাকা দামের কেক পাওয়া যায়। ১২৫ টাকা প্রতি পাউণ্ডের দাম। হাফ পাউন্ডের থেকে একটু বড় সাইজের কেকের দাম পড়ছে ৮০ টাকা। ২.৫ পাউণ্ডের দাম পড়ছে ২৫০ টাকা। চকলেট কেক ১৭৫ টাকা প্রতি পাউন্ড। সুগার ফ্রি ১৫০ টাকা প্রতি পাউন্ড। এর সাথে থাকে ৫ টাকার ছোট মাফিন কেকও পাওয়া যাচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন, প্রতি ব্যাচ তৈরী করতে ১ থেকে দেড় ঘন্টা সময় লাগে। বছরের অন্যান্য সময় কেক পাওয়া না গেলেও পাউরুটি এবং স্পেশাল লেরুয়ার জন্য ‘অনাদি বেকারি’-র কাউন্টারে লাইন পরে সারা বছরই।

Exit mobile version