বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- “পশু খাদ্য মামলায় লালু প্রসাদ যাদবের বিরুদ্ধে যা যা ধারা প্রয়োগ হয়েছে এরাজ্যের রেশন দুর্নীতি মামলায়ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সেই সব ধারাই লাগু হওয়া উচিত।” সাংবাদিক বৈঠকে জানালেন সিপিআই(এম) পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সোমবার ও মঙ্গলবার পার্কাস রোডে জেলা দপ্তরে অনুষ্ঠিত হলো পূর্ব বর্ধমান জেলা সিপিআই(এম)-এর ২ দিনের বর্ধিত অধিবেশন। উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, অমল হালদার, অচিন্ত্য মল্লিক, সৈয়দ হোসেন, অঞ্জু কর, আভাস রায় চৌধুরি প্রমুখ। মঙ্গলবার বর্ধিত অধিবেশনের মাঝেই সাংবাদিক বৈঠক করেন মহম্মদ সেলিম। এদিন সাংবাদিক বৈঠকে মহম্মদ সেলিম জানিয়েছেন, ৩ থেকে ৫ নভেম্বর রাজ্যের বর্ধিত অধিবেশন হয়েছে। তারপর জেলার বর্ধিত অধিবেশন শুরু হয়েছে। সামনে লোকসভা নির্বাচন। পঞ্চায়েত ভোটের অভিজ্ঞতা, বেকারি, চাষীদের সমস্যা, সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের সমস্যা নিয়ে এবং এসমস্ত বিষয়ে পার্টির ও গণসংগঠনগুলির কর্মসূচি কী ছিল সব নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে। সামনেই লোকসভা নির্বাচন। আন্দোলনকে আরো বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও এই সভা। লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি কী আছে, কী করতে হবে -সবই আলোচনায় উঠে এসেছে। জেলা কমিটির নেতৃত্ব ছাড়াও গোটা জেলার বিভিন্ন স্তরের অন্যান্য নেতৃত্বরাও ছিলেন এই বর্ধিত অধিবেশনে। সেলিম জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্তদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। একটা গলার স্বরের নমুনা নেওয়ার জন্য গোটা চিকিৎসা বিভাগ, এসএসকেএম হাসপাতাল, চিকিৎসকদের পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। যে কোনও দুর্নীতির তদন্ত হলে আলাদা আলাদা সংস্থা, ব্যক্তিকে তার মধ্যে ডুবিয়ে নেওয়া হয়। যে কোনও বেআইনি কাজের র্যাকেট তৈরি হয়। ইডি, সিবিআই অসহায় -এটা নিয়ে খবর হচ্ছে। তাঁরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকছে। হাইকোর্টের নির্দেশ থাকলে সেটা কার্যকরী করা যায় না! তিনি বলেন, এ ‘কাকু’ যে-সে কাকু নয়। যেমন এই ‘পিসি’ যে-সে পিসি নয়। আরএসএস আমাদের রাজ্যে ধর্মের রাজনীতি করেছে। পরিবর্তনের নামে তৃণমূল কংগ্রেসকে তৈরি করে এখানে বিজেপির জায়গাটা তৈরি করে দিয়েছে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বাড়ানোই উদ্দেশ্য। বামপন্থী রাজনীতিকে নিকেশ করার জন্য এটা দরকার। এই রাজ্যে এই ধরনের লোকজনকে লিয়েন দিয়েছিল আরএসএস। তৃণমূলের দুর্নীতিতন্ত্রকে বাড়ানোর জন্য। এখন বিজেপি বড়বড় কথা বলছে। কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলো খুব পরিকল্পনামাফিক মাঝে মধ্যে খাপ থেকে বের হচ্ছে আবার ঝাঁপির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। গত কয়েকমাস আগে আমরা দেখলাম কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ভাইপোকে ডাকছে, তাঁর পরিবারের সকলকে ডাকছে। এখন দেখছি সব চুপ। এমনকি বিজেপির নেতারাও এখন ভাইপো সম্পর্কে চুপ। কারণ কয়েকদিন আগে আরএসএস তাঁদের পত্রিকায় লিখে দিয়েছে, অবোধ গরু, বাছুর। সুতরাং তাঁকে বধ করে কী হবে। আর তারপর থেকেই তাবড় তাবড় নেতারাও কিছু বলছেন না। যত বামপন্থীরা শক্তিশালী হচ্ছে বিজেপি দেখছে মন্দের ভালো তৃণমূল কংগ্রেস থাক। ভাইপোকে ছেড়ে দিয়ে এখন চলছে কাকু পর্ব। আগামী ২০ ডিসেম্বর দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, দিদি দিল্লী যাচ্ছেন। বাইরে বলছেন ইন্ডিয়া জোটকে শক্তিশালী করার জন্য ১৯ ডিসেম্বর দিল্লী যাচ্ছেন। আর ২০ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করবেন একান্তে। রাজ্যের পাওনাগণ্ডা মেটানোর কথা বলবেন। কিন্তু গত ১ বছরে কত মেটানো হয়েছে সেগুলো জানানো হচ্ছে না কেন? কেন্দ্রের থেকে আসা বিভিন্ন ফান্ড নিয়ে যে নয়ছয় হয়েছে তা নিয়ে কেন্দ্র ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? এটা তো ফৌজদারি অপরাধ। তারজন্য কেস করে দোষীদের শাস্তি দিতে হয়। গরীব মানুষ টাকা পাচ্ছে না। এটা লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে আসন সমঝোতার বৈঠক। নেতাদের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নোট বন্দী করে বলেছিলেন কালো টাকা সাফ হয়ে গেছে। তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে শুরু করে কংগ্রেস নেতাদের কাছ থেকে কোটি কোটি কালো টাকা উদ্ধার হচ্ছে কী করে? বিজেপি নেতারা বলছেন ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু আগের থেকে বেশি টাকা ছেপে বাজারে ছাড়তে হলো কেনো? ইলেক্টোরাল বন্ড বন্ধ করছে না কেন? স্বচ্ছতা নেই কেনো? কার টাকা? কাকে দিচ্ছে? কে দিচ্ছে? -জানানো হচ্ছে না। তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা সব থেকে বেশি পেয়েছে বিজেপি, তারপরই তৃণমূল কংগ্রেসের। টাকা উদ্ধারের সময় যতদিন টাকা গোনা হয় ততদিন খবর হয়। তারপর কী হয়? সব চাপা পড়ে যায়। কয়েকদিন আগে বিজেপির একজনের কাছ থেকেও ২৫৬ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি যোগ পাওয়ার পর আর কিছু জানা যাচ্ছে না। সবাই চুপ। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শা প্রতিশ্রুতি দিক টাকা উদ্ধারের পরে খবরও হবে, তদন্তও চলবে। আর দুর্নীতিগ্রস্তদের দলে নেওয়া হবে না। এটা দুর্নীতি শেষ করা নয়, দুর্নীতিগ্রস্তদের দলে নিয়ে আসা।
দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐক্যকে ভাঙার চেষ্টা চলছে। রাম মন্দির উদ্বোধন করার নাম করে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তৈরি করার চেষ্টা চলছে। মানুষের আয় কমছে, ব্যয় বাড়ছে। সেদিক থেকে নজর সরিয়ে দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করার চেষ্টা চলছে। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বে? বিজেপি বলছে গীতা পাঠ করাবো। তার আগে তৃণমূল কংগ্রেস প্র্যাকটিস করা শুরু করে দিয়েছে। বিজেপি মঞ্চে অভিনয় করার আগে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রীরা রিহার্সাল শুরু করেছে। ধর্ম নিয়ে প্রতিযোগিতা চলবে। সেটা নিয়েই সারাদিন আলোচনা চলবে। কে বেশি ভক্ত তা নিয়ে আলোচনা হবে। মানুষের জীবন যন্ত্রণার প্রশ্ন থেকে সরিয়ে দিয়ে ভোটের আগে ধার্মিক উন্মাদনা তৈরি করতে চায়। ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবেন বলে জানা যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, রাজ্যের দাবিদাওয়ার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, বিভাগীয় মন্ত্রী-সহ রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ আমলারা থাকার কথা কিন্তু এটা পুরোপুরি রাজনীতি। এটা ‘বৈঠক’ নয়। ‘বৈ’ কম ‘ঠক’ বেশি। এখানে বই-খাতা নেই, শুধু ঠকবাজি আছে। দিল্লীতে মোদী এবং রাজ্যে দিদি যতদিন আছে ততদিন দুর্নীতি থাকবে, লুট চলবে। দুর্নীতির ব্যাকওয়ার্ড এবং ফরওয়ার্ড লিংকেজ করা হয়েছে।
রেশন বণ্টন দুর্নীতি মামলা প্রসঙ্গে এদিন সেলিম বলেন, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে খাদ্যমন্ত্রী এবং ফুডের সংস্থার চেয়ারম্যান কে করেছেন? পশু খাদ্য মামলায় লালু প্রসাদ যাদবের বিরুদ্ধে যা যা ধারা প্রয়োগ হয়েছে সব ধারাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেই লাগু করা যায়। আবগারি দপ্তরেও একই চলছে।
ইন্ডিয়া জোট প্রসঙ্গে সেলিম জানিয়েছেন, ওটা টাকার জোট নয়, নির্বাচনী জোটও নয়। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া নির্বাচনেও ইন্ডিয়া জোটের হয়ে ভোট হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সংবিধান রক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বাঁচাতে জোট করতে হবে। বিজেপি-তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সব দল একযোগে লড়াই করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গ সফরে গেছেন ভালো করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী গিয়ে চা পাতা তুলেছেন। কিন্তু এই সময় চা পাতা তোলা হয় না। সরকারি লোক সঙ্গে নিয়ে চা পাতা তুলেছেন। এগুলোকে নাটক বলে। রাজ্যের নিয়োগ দুর্নীতি প্রসঙ্গে এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, যাঁদের চাকরি হওয়ার কথা তাঁদের চাকরি পিসি-ভাইপো-শিক্ষামন্ত্রীরা মিলে বিক্রি করেছেন। তারপর অনেকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সমস্যার কারণ, সমস্যার সমাধান নয়। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বঞ্চনা নিয়ে উত্তরবঙ্গে গিয়ে কেন বলছেন, ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বলুন।