বিপুন ভট্টাচার্য, বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- পূর্ব বর্ধমান জেলায় গলসী, ভাতার, আউশগ্রাম সহ দক্ষিণ দামোদরের বিস্তীর্ণ এলাকায় আমন ধানের জমিতে সেচের জলের তীব্র সংকটে ইতিমধ্যেই জেলার বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন কৃষকরা। কিন্তু তাতেও কোনোরকম পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সেচের জলের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে চলতি মরশুমে আমন চাষের এলাকায়। চলতি মরশুমে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার হেক্টর এলাকায় আমন চাষ হয়েছে বলে কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু তার মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ হেক্টর এলাকা সেচের জলের অভাবে ধুঁকতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই ধানে গুছি এসে গেছে। এই সময় জলসংকট দেখা দেওয়ায় চরম উদ্বেগে দিন কাটছে চাষীদের। আমনের ফলন ভয়ংকররকম ভাবেই মার খাবার আশংকা করছেন চাষীরা। এদিকে, সেচের এই জলের অভাব মেটাতে গত ১০ অক্টোবর বর্ধমানে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে জল সংকট মোকাবিলায় বন্ধ হয়ে থাকা সাবমার্শিগুলি চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এব্যাপারে বিদ্যুত দপ্তরকে দ্রুত বিদ্যুত সংযোগ দেবার নির্দেশও দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরেও কোনো পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতই ফলন্ত ধান গাছে জল সংকটের জেরে জায়গায় জায়গায় আমন ধানে ঝলসা ও বাদামী শোষক পোকার উপদ্রব দেখা দিতে শুরু করেছে। জেলা কৃষি দপ্তরের আধিকারিক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, গোটা জেলায় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার হেক্টর এলাকায় এই রোগ দেখা দিলেও তা নিয়ে আতংকিত হবার মত কিছু নেই। এদিকে, আমন চাষের পরেই বোরো মরশুম শুরু হতে চলেছে। ফলে সেচের জলের চাহিদা আরও বাড়তে চলেছে। কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে দামোদর ও ঝাড়খণ্ডের তেনুঘাটের জলাধারে জল না থাকায় সমস্যা আরও তীব্রতর আকার নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপাতত আমন ধান বাঁচানোর লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার বর্ধমানে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে নতুন করে শুক্রবার থেকে তিনদিন জল দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। একইসঙ্গে চাষীরা যাতে বিভিন্ন জায়গায় জল আটকে দেবার মত পরিস্থিতি না হয় সেজন্য জেলার সংশ্লিষ্ট ব্লকের বিডিওদের স্বশরীরে হাজির থেকে জলের তদারকি করার নির্দেশ দেওয়া হল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সহকারী সভাধিপতি দেবু টুডু এদিন জানিয়েছেন, সম্প্রতি কাঁকসায় এইভাবেই চাষীরা ক্যানেলের জল আটকে নিজেদের জমিতে জল পৌঁছানোর উদ্যোগ নেন। তা নিয়ে হাতাহাতিও হয়। তাই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না হয় সেজন্য এদিন সজাগ থাকতে বলা হয়েছে খোদ বিডিওদের। বৃহস্পতিবার ছুটির দিনেই পরিস্থিতির মোকাবিলায় বর্ধমানের বিডিএ হলে আয়োজিত এই বৈঠকে হাজির ছিলেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী আশীষ বন্দোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার, রাজ্যের প্রাণী সম্পদ বিকাশ দপ্তরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, জেলা পরিষদের সভাধিপতি শম্পা ধাড়া, সহকারী সভাধিপতি দেবু টুডু, জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব সহ জেলার সমস্ত বিধায়ক, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আধিকারিক, বিদ্যুত দপ্তরের আধিকারিক, বিডিও এবং জনপ্রতিনিধিরাও। এদিন বৈঠকে রীতিমত বিদ্যুত দপ্তরের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলেন বর্ধমান পূর্বের সাংসদ সুনীল মণ্ডল। তিনি জানান, গত ১০ অক্টোবর সেচের জল সরবরাহ সংক্রান্ত বৈঠকে যে সমস্ত চাষীদের বিদ্যুতের বিল বকেয়া থাকার জন্য সাবমার্শিবলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল তা পুনসংযোগের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হলেও তা পালন করা হয়নি। এদিন উপস্থিত বিদ্যুত দপ্তরের প্রতিনিধিদের কাছে কেন বিদ্যুত সংযোগ দেওয়া হয়নি সে ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করেন সুনীলবাবু। যদিও বিদ্যুত দপ্তরের রিজিওনাল ম্যানেজার দিলীপ কুমার বাছাড় জানিয়েছেন, কেবলমাত্র পূর্ব বর্ধমান জেলায় ১২০ কোটি টাকা বিদ্যুতের বিল বকেয়া পড়ে রয়েছে। জেলার মোট ৭০টি সাবমার্শিবলের বিদ্যুত বিল দীর্ঘদিন বকেয়া পড়ে থাকার জন্যই সেগুলির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও সহজ শর্তে লিখিতভাবে চাষীদের আবেদন মেনে ইতিমধ্যেই ভাতার, আউশগ্রাম, রায়না এবং খণ্ডঘোষে ৭০টি সাবমার্শিবলেরই সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এদিকে, বৃহস্পতিবার এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যেহেতু এবারে বৃষ্টির পরিমাণ অত্যাধিক কম হওয়ায় দামোদর এবং তেনুঘাট জলাধারে পর্যাপ্ত জল নেই। দামোদরে যে জল রয়েছে আমন চাষের জন্য তা থেকে মাত্র ৪০ হাজার একর ফিট জল দেওয়া সম্ভব। এমনকি ২০১৫ সালে একইরকম সংকটে তেনুঘাট থেকে রাজ্য সরকার জল কিনে তা সরবরাহ করলেও এবারে তেনুঘাটেও বিক্রিযোগ্য জল না থাকায় পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে। আর তাই এদিনের বৈঠকে স্থানীয়ভাবে যে সমস্ত জলাশয়, পুকুর, নদী, নালা রয়েছে সেগুলি থেকে জল সরবরাহ করার ওপর জোড় দেওয়া হয়েছে। এরই পাশাপাশি রাইসমিলগুলিকেও তাদের পাম্পের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জল সরবরাহ করার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। শুক্রবার থেকে যে সামান্য পরিমাণ জল ছাড়া হবে তা আদৌ শেষ পর্যন্ত পৌঁছাবে কিনা কিংবা তা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে রীতিমত সংশয় তৈরী হয়েছে। অন্যদিকে, চাহিদামত জল না পেলে এবছর শস্যগোলা বর্ধমানে আমন চাষে ভয়াবহ ক্ষতির আশংকাও করছেন চাষীরা। এদিন মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার আমন চাষের পরেই বোরো চাষে কম জলে চাষ হওয়া ধানের পরিবর্তে গম বা সেই ধরণের চাষের জন্য চাষীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য কৃষি দপ্তর এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এব্যাপারে চাষীদের বোঝাতে জোরদারভাবেই মাঠে ময়দানে জনপ্রতিনিধিদের নামার আবেদন জানিয়েছেন প্রদীপবাবু। বস্তুত, বৃষ্টি না হলে চলতি আমন সহ আসন্ন বোরো মরশুমেও যে চাষের ভয়াবহ অবনতি হতে চলেছে সে ব্যাপারেও এদিন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৈঠকে হাজির হওয়া প্রতিনিধিরা।
একদিকে যখন আমন চাষে জল সরবরাহের জন্য জেলা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক চলেছে খোদ মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে, সেই সময় সেচের জলের দাবীতে রায়নার শ্যামসুন্দরে কিষাণ মাণ্ডির সামনে সেচের জলের দাবীতে হাতে পোষ্টার, ব্যানার নিয়ে রাস্তা অবরোধে সামিল হলেন কৃষকরা। স্থানীয় কৃষক আজিজুল মণ্ডল জানিয়েছেন, এদিনের বৈঠকে প্রশাসনের কর্তারা বলেছেন ৪০ হাজার একর ফিট জল দেওয়া হবে। কিন্তু সেই জল গড়িয়ে রায়নার জমিতে কখনই আসবে না। আবার সাবমার্শিবলের জল কেনার আর্থিক সামর্থ্যও সকলের নেই। এমতবস্থায় জলের অভাবে ধান নষ্ট হলে চাষীদের আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।