বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়ে আমন চাষে জল সংকটের ঘটনায় এবার জায়গায় জায়গায় চাষীদের হাহাকার শুরু হল। ইতিমধ্যেই জেলার ভাতার, আউশগ্রাম সহ রায়না ১ ও ২ এবং খণ্ডঘোষ এলাকায় চাষের এই জল সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সেচের জলের অভাবে ধান গাছ নষ্ট হওয়ায় ক্ষতির আশংকায় এক ভাগচাষী আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগও উঠেছে। মৃত ভাগচাষীর নাম স্বপন মাঝি (৬৫)। বাড়ি আউশগ্রামের ভেদিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সাঁতলা গ্রামে। মৃত ভাগচাষীর দাদা বনমালী মাঝি, ছেলে মোহন মাঝি প্রমুখরা জানিয়েছেন, এবছর আমন চাষে স্বপনবাবু প্রায় ১০ বিঘে জমিতে ভাগচাষ করেছিলেন। সম্প্রতি ধান ফোলাতে শুরু করেছে। কিন্তু তীব্র সেচের জল সংকট দেখা দেওয়ায় ধান গাছ নষ্ট হতে শুরু করেছে। অন্যদিকে জল সংকটের জেরে ধানে পোকারও উপদ্রব দেখা দিয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, এই চাষ করতে গিয়ে বেশ কিছু টাকা ধারও হয় স্বপনবাবুর। তা নিয়ে অশান্তি শুরু হয় স্ত্রীর সঙ্গে। এর জেরেই গত সোমবার বিকালে মাঠে গিয়ে তিনি বিষ খান। গ্রামবাসীরাই দেখতে পেয়ে তাঁকে প্রথমে বোলপুরের সিয়ান হাসপাতাল এবং পরে তাকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার পর রবিবার তার মৃত্যু হয়। যদিও জলের অভাবে ধান নষ্টের কারণে ভাগচাষীর মৃত্যুর বিষয়টি প্রশাসনের কর্তারা স্বীকার করেননি। আউশগ্রাম ২এর বিডিও সুরজিত ভর জানিয়েছেন, এখনও আউশগ্রামের কোথাও জলের অভাবে ধান গাছ নষ্ট হবার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তাই ওই ব্যক্তি কি কারণে মারা গেছেন তা নিয়ে খোঁজখবর নিতে জেলা কৃষি দপ্তরকে বলা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, একজনের মৃত্যু সংবাদ তাঁরা পেয়েছেন। তবে চাষের ক্ষতির জন্য তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা নেই। গোটা বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু হয়েছে। এদিকে, গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়েই আমন চাষের জমিতে তীব্র জলের হাহাকারের ঘটনায় ক্রমশই পরিস্থিতি ঘোরালে হয়ে উঠছে। সোমবারও ভাতারের প্রায় ১০টি গ্রামের চাষী সেচের জলের দাবীতে বিডিও-র কাছে লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি যা তাতে দামোদরের ক্যানেলের মাধ্যমে কোনোভাবেই আর জল পাওয়া সম্ভব নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিকল্প জলের ব্যবস্থার দাবীতে চাষীরা সোচ্চার হয়েছেন। ভাতার ব্লকের আড়রা, আমারুন, এওড়া, নওদা, ঘুঘিয়া, এড়াচিয়া, শুনুর সহ আমারুন ষ্টেশন সংলগ্ন এলাকার চাষীরা রীতিমত ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, ভাতার ব্লকের একাংশকে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছে। দীর্ঘ কয়েকবছর ধরেই এই এলাকার চাষীরা ক্যানেলের মাধ্যমে জল পাচ্ছেন না। এব্যাপারে এর আগেও প্রশাসনের সর্বস্তরে জানানো হয়েছিল কিন্তু কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এবছরও প্রকৃতির রোষের মুখে পড়েছেন এলাকার চাষীরা। বৃষ্টির দেখা না মেলায় আমন ধানের চাষে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অন্যদিকে, যে সমস্ত চাষীদের সাবমার্শিবল রয়েছে তাঁরাও বিদ্যুতের খরচ জোগাতে গিয়ে সাবমার্শিবল হয় চালাতে চাইছেন না, অথবা চাষীদের কাছ থেকে সেই খরচের টাকা তুলতে গিয়ে চাষীদের জলের দাম দিতে নাভিশ্বাস উঠছে। এলাকার চাষী স্বরূপ সরকার জানিয়েছেন, চলতি সময়ে ভাতার ব্লকের এই সমস্ত গ্রামে বিঘে প্রতি সাবমার্শিবল জলের জন্য দিতে হচ্ছে ১৫০০ টাকা। যা জোগাতে গিয়ে রীতিমত হিমসিম খেতে হচ্ছে চাষীদের। তিনি জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই এই এলাকায় সেচের জল পৌঁছায় না। আবার বৃষ্টির দেখা নেই। স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্ত গ্রামের চাষীদের জীবন ধারণ নিয়েই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক শেষে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার জানিয়ে যান, চাষীদের এই সংকট মেটাতে ডিভিসি জলাধারে থাকা বোরো মরশুমের জন্য সঞ্চিত ৪০ হাজার একর ফিট জলকে ছেড়ে দেওয়া হবে ৩দিন ধরে। তাঁর সেই ঘোষণা অনুসারে যথারীতি জল ছাড়া হলেও রায়না ১ ও ২, খণ্ডঘোষ, ভাতার এবং আউশগ্রামের চাষীরা জানিয়েছেন, তাঁরা ঘোষণাই শুনেছেন কিন্তু ক্যানেলে জলের দেখা পাননি। ফলে সরকারী ঘোষণা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এব্যাপারে ভাতারের বিডিও শুভ্র চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এব্যাপারে চাষীদের কাছ থেকে তাঁরা অভিযোগ পেয়েছেন। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অভিযোগের বিষয়ে জানান হবে। এব্যাপারে এলাকা পরিদর্শন করা হতে পারে বলেও তিনি জানিয়েছেন। অন্যদিকে, এই ঘটনা সম্পর্কে জেলা কৃষি আধিকারিক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ওই চাষীর শস্যবীমা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। তবে আত্মহত্যার কোনো খবর তাঁরা পাননি। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, এবছর ক্যানেলের মাধ্যমে জল পাওয়া যাবেনা তাঁরা বুঝতে পেরেই বাড়ি বাড়ি চাষীদের শস্য বীমা করার জন্য লিফলেট পৌঁছানো হয়েছে। কিন্তু সেভাবে চাষীদের কাছ থেকে সাড়া মেলেনি। তিনি জানিয়েছেন, জল সংকট মেটাতে চলতি সময়ে প্রায় ৩ হাজার সাবমার্শিবলের সংযোগ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয় সেখানেই ডিভিসির প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ২০দিন একটানা জল দিলে তবেই ক্যানেলের শেষ প্রান্তে জল পৌঁছানো সম্ভব। তিনি জানিয়েছেন, এই মূহূর্তে গোটা জেলার মধ্যে মাত্র ৩৫ হাজার হেক্টর এলাকা জলের অভাবে সমস্যার মুখে রয়েছে। তবে এখনই বৃষ্টি হলে সবটাই বাঁচানো সম্ভব হবে।