বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- গত ২৫ এপ্রিল থেকে গোটা রাজ্যের পাশাপাশি পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়েই আইনজীবীদের কর্মবিরতির জেরে তীব্র সংকট দেখা দিল আইনজীবীদের সংশ্লিষ্ট টাইপিষ্ট, স্ট্যাম্প ভেণ্ডার, ল-ক্লার্ক প্রমুখদের। গত প্রায় ২০দিন ধরে বর্ধমান জেলা আদালতের আইনজীবীরা কর্মবিরতি পালন করতে থাকায় চুড়ান্ত রুজিরুটিতে টান পড়েছে সংশ্লিষ্ট এই সমস্ত পেশার মানুষদের। বর্ধমান জেলা কোর্ট টাইপিষ্ট এ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক গৌরীশংকর ঘোষ জানিয়েছেন, আইনজীবীদের এই কর্মবিরতির জেরে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গত কয়েকদিন ধরে কোনো রোজগার নেই। প্রতিদিনই তাঁরা আশায় আশায় এসে রাস্তার ধারে টাইপ মেশিন নিয়ে বসছেন। কিন্তু দিনের শেষে রোজগারহীন হয়ে বাড়ি ফিরছেন। একই কথা জানিয়েছেন, ১৯৭২ সাল থেকে বর্ধমান আদালত চত্বরে টাইপিষ্ট হিসাবে কাজ করে চলা প্রদীপ ব্যানার্জ্জী। তিনি জানিয়েছেন, এই কর্মবিরতির জেরে গত কয়েকদিন ধরেই আয় এক চতুর্থাংশ কমে গেছে। ফলে চরম সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭২ সাল থেকে তিনি বর্ধমান আদালত চত্বরে টাইপিষ্টের কাজ করছেন। এর আগে বাম আমলে ২০০৪ সালে স্ট্যাম্প ডিউটি বাড়ানোর প্রতিবাদে ৪৪ দিন আন্দোলন হয়েছিল। সেই সময় একটা তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এবারে গত ২০দিনেই তাঁদের নাজেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, তীব্র গরমের জেরে অনেক মানুষই আদালতে আসতে চাইছেন না। তার ওপর আইনজীবীদের কর্মবিরতির জেরে রোজগার একেবারে শূন্যতে এসে ঠেকেছে। বর্ধমান আদালতের ল-ক্লার্ক পারমিতা ভট্টাচার্যও জানিয়েছেন, প্রতিদিনের রোজগারের ওপর তাঁর সংসার চলে। কিন্তু গত কয়েকদিনে রোজগার একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কার্যত প্রতিদিনই শূন্য হাতে তাঁদের ফিরে যেতে হচ্ছে। এভাবে বেশিদিন চললে না খেতে পেয়েই মরতে হবে। তিনিও আবেদন করেছেন যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। উল্লেখ্য, পূর্ব বর্ধমান জেলা আদালতে আইনজীবীদের কর্মবিরতিতে চরম সংকটের মুখে পড়েছেন পুর্ব বর্ধমান জেলা আদালতের প্রায় ৬০ জন টাইপিষ্ট, ৬০০ জন ল-ক্লার্ক তথা মুহুরী, প্রায় ৬০জন জামিনদার, বর্ধমান সদরের ৩৯ জন স্ট্যাম্প ভেন্ডার, ৭জন নোটারিয়ান এবং ৩জন ম্যারেজ রেজিষ্ট্রারও। গত ২৪ এপ্রিল হাওড়া আদালতের আইনজীবীদের সংগে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় পরের দিন থেকেই শুরু হয় গোটা রাজ্য জুড়ে আইনজীবীদের আন্দোলন। এই ঘটনায় দোষী পুলিশ অফিসারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন আইনজীবীরা। গত ২৫ এপ্রিল থেকে পুর্ব বর্ধমান জেলা আদালতে আইনজীবীদের এই কর্মবিরতির জেরে রীতিমতো আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন বর্ধমান আদালতের টাইপিষ্ট, মহুরী তথা ল-ক্লার্ক এবং স্ট্যাম্প ভেন্ডাররা। স্ট্যাম্প ভেণ্ডার কৃষ্ণা ব্যানার্জী জানিয়েছেন, কর্মবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে স্ট্যাম্প পেপার বিক্রি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। তাঁরা চাইছেন দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। ল-ক্লার্ক পিণ্টু চৌধুরীও জানিয়েছেন, তাঁরা চান আইনজীবীদের সম্মান এবং দাবীকে মেনে নিয়ে দ্রুত দোষীদের শাস্তি ঘোষণা করে সমস্যা মেটানো হোক। পশ্চিমবঙ্গ লক্লার্ক এ্যাসোসিয়েশনের সহ সম্পাদক প্রণয় মিত্র জানিয়েছেন, আইনজীবীদের সম্মান ফিরে আসা জরুরী। কারণ উকিলবাবুদের ওপরই তাঁদের জীবিকা নির্ভর করে। তাই তাঁরাও এই আন্দোলনে উকিলবাবুদের সঙ্গে রয়েছেন। তিনিও স্বীকার করেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সত্যিই সমস্যায় রয়েছেন মুহুরীরা। নোটারিয়ান আশীষ দাস জানিয়েছেন, আইনজীবীদের সম্মান ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। সেই সম্মান ফিরে আসার জন্যই এই আন্দোলন চলছে। সেক্ষেত্রে অনেকের সমস্যা দেখা দিলেও বৃহত স্বার্থে এটা সকলেই মেনে নিয়েছেন। অন্যদিকে, যতক্ষণ না দোষী পুলিশ অফিসারদের দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ তাঁরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন বর্ধমান বার এসোসিয়েশনের সম্পাদক সদন তা। তিনি জানিয়েছেন, যেভাবে পুলিশ দুর্নিবার হয়ে উঠেছেন তাতে একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজীর সৃষ্টি না হলে ভবিষ্যতে পুলিশ আইনজীবীদের এজলাসে ঢুকেও অত্যাচার চালাবে। সদনবাবু স্বীকার করেছেন, টাইপিষ্ট, মুহুরী সহ সংশ্লিষ্ট সকলেই এই কারণে অসুবিধায় পড়েছেন। তবে তাঁরা আশা করছেন নিশ্চয়ই সম্মানজনক একটি সিদ্ধান্ত নেবে বার কাউন্সিল। তাঁরা সেই দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। অপরদিকে, খোদ আইনজীবী মহল সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২১ মে ফের বার কাউন্সিল এই ইস্যুতে আলোচনায় বসতে চলেছে। তার আগে কলকাতা হাইকোর্টে এব্যাপারে মামলার শুনানিও শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, আগামী ২৩ মে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগে এই সমস্যা মেটার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এরই মাঝে ২ জুন থেকে ৭ দিনের জন্য আদালতে গরমের ছুটি পড়বে। ফলে সবমিলিয়ে আগামী ১২ জুনের আগে এই কর্মবিরতি মেটার কোনো আশাই দেখছেন না আইনজীবী মহল। সদনবাবু স্বীকার করেছেন, কেবলমাত্র ল-ক্লার্ক, টাইপিষ্ট বা ভেণ্ডার প্রমুখরাই নন, এই আন্দোলনের জেরে আর্থিকভাবেও সংকটে পড়ছেন আইনজীবীরাও। কিন্তু নিজেদের পেশার সম্মানের তাগিদে সকলেই এই আন্দোলনকে সর্বতোভাবে মেনে নিয়েছেন।