খণ্ডঘোষে দাপিয়ে ভোট করল তৃণমূল, ছাপ্পার অভিযোগে সরানো হল দুই প্রিসাইডিং অফিসারকে
admin
বিপুন ভট্টাচার্য, খন্ডঘোষ ও গলসী (পূর্ব বর্ধমান) :- রবিবার বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর লোকসভার ভোটে পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষ বিধানসভায় ব্যাপক ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠল শাসকদলের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, রীতিমত কৌশলী ভোটের পাশাপাশি জায়গায় জায়গায় বিজেপি এবং সিপিএম সমর্থকদের হুমকি ও মারধর করারও অভিযোগ উঠল শাসকদলের বিরুদ্ধে। রবিবার সকাল থেকেই এই বিধানসভার ২৭১টি বুথের সিংহভাগ এলাকাতেই ছিল উপচে পড়া ভিড়। খণ্ডঘোষ বিধানসভার অধীন গলসী ২নং ব্লকের বেশ কয়েকটি বুথে ছিল না আধা সামরিক বাহিনী। ফলে সকাল থেকেই ধাপে ধাপে শাসকদল ছাপ্পা ভোটের মহরত সেরে নিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। এদিকে, শাসকদলের ছাপ্পা ভোটের অভিযোগে এদিনই নির্বাচন কমিশন গলসীর মসজিদপুর এবং খণ্ডঘোষের দুবরাজহাটের প্রিসাইডিং অফিসারকে সরিয়ে দেওয়ায় বিরোধীদের অভিযোগে সিলমোহর দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক চাঞ্চল্যও ছড়িয়েছে। ছাপ্পা ভোটের অভিযোগে গলসীর মসজিদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং অফিসার দিলীপ কুমার মুন্সীকে সরিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। একইভাবে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের খণ্ডঘোষের দুবরাজহাট শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ১১৮ নম্বর বুথের প্রিসাইডিং অফিসার সুব্রত ঘোষকেও ছাপ্পা ভোটের অভিযোগে সরিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন। পরপর দুজন প্রিসাইডিং অফিসারকে ছাপ্পা ভোটে শাসকদলকে সহায়তা করার ঘটনায় সরিয়ে দেওয়ায় অস্বস্তি বেড়েছে শাসকদলের। যদিও শাসকদলের বিরুদ্ধে ছাপ্পা দেওয়ার অভিযোগ উঠলেও পাল্টা রাজ্যের শাসকদলের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হল খোদ আধা সামরিকবাহিনীর বিরুদ্ধেই। বিরোধীদের তোলা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খণ্ডঘোষ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অপার্থিব ইসলাম পাল্টা অভিযোগ তুলে জানিয়েছেন, আধা সামরিক বাহিনীই বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটকর্মীদের প্রভাবিত করেছেন। এদিনই তাঁরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে নয়নয় করেও ২০টি এই ধরণের অভিযোগ দাখিল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তীব্র গরমের জেরে রবিবার ভোর থেকেই ভোটের জন্য খণ্ডঘোষ বিধানসভার গলসীর বেশ কিছু বুথে লাইনে দাঁড়ান ভোটাররা। এদিন গলসী এবং খণ্ডঘোষের বহু বুথেই দেখা মেলেনি আধা সামরিক বাহিনীর। আবার এমন অনেক বুথ দেখা গেছে যেখানে পর্যাপ্ত রাজ্য পুলিশও নেই। কার্যত এই সমস্ত বুথেই শাসকদল দাপিয়ে নিজেদের অনুকূলে ভোট করিয়েছেন। আবার এমন অনেক বুথও দেখা গেছে আধা সামরিক বাহিনীকে শ্রীখণ্ডী খাড়া করে সেখানেই দেদার চলছে ছাপ্পা ভোট। কার্যত বুথের মধ্যে আধা সামরিকবাহিনীকে রাখা যাবে না – এই ফর্মূলাতেই এবারের লোকসভা নির্বাচনে বাজিমাত করল শাসকদল। অন্যদিকে, ঠিক উল্টেদিকে রবিবার গলসীর তাহেরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আধা সামরিক বাহিনীর আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা ভেদ করতে না পারায় রীতিমত এলাকায় উত্তেজনার সৃষ্টি করলেন তৃণমূলের নেতারা। খবর পেয়ে বিশাল পুলিশ বাহিনী এসে তাদের হঠিয়ে দেয়। তাহেরপুরে তৃণমূলের দাবী ছিল, বুথের বাইরে স্কুলের গেটে রাখতে হবে আধা সামরিকবাহিনীকে। এরই পাশাপাশি এদিন দফায় দফায় বিভিন্ন জায়গায় বুথের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তৃণমূলের সমর্থকরা জমায়েত করায় পুলিশ তাদের হঠিয়ে দিয়েছে। গলসীর কেটনা বুথে বিজেপি সমর্থকদের ভোট দিতে বাধা দেবার অভিযোগ উঠেছে। গলসীর মোঘলসীমা বুথের বাইরে নকল ব্যালট নিয়ে ভোটের দিনও প্রচার চালিয়েছে তৃণমূল। ভূঁড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সুবোধ ঘোষ অভিযোগ করেছেন, জুজুটু, মোহনপুর, কেটনা প্রভৃতি সমস্ত বুথেই যে ইভিএম মেশিন রাখা হয়েছে সেগুলিতে তৃণমূলের প্রতীক ছিল অস্পষ্ট এবং ছোট। পরিবর্তে বিজেপির প্রতীক ছিল বড় ও স্পষ্ট। এনিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন ভোটাররা। গলসীর উড়ো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথের গেটের সামনে দাঁড়িয়েই তৃণমূল নেতারা দাপিয়ে ভোট করেছেন রাজ্য পুলিশকে বগলদাবা করে। নামকা ওয়াস্তে রাজ্য পুলিশ খাড়া থাকলেও তৃণমূলের দাদাগিরিই ভোট পরিচালনা করেছে। অন্যদিকে, খণ্ডঘোষ বিধানসভার ১২৩ নং বুথে তৃণমূলের হামলায় মাথা ফাটলো কার্তিক ঘোষ নামে এক বিজেপি সমর্থকের। খণ্ডঘোষ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের ২১০ নং বুথ উখরিদ হরিজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে এদিন নির্দিষ্ট জায়গার বদলে সমস্ত ভোট বিজেপিতে পড়ে যাওয়ার অভিযোগে ভোটদান বন্ধ থাকে বেশ কিছুক্ষণ। পরে প্রশাসনের কর্তারা গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন, অভিযোগের কোনো সত্যতা মেলেনি, ভোট যথারীতি ওই মেশিনেই করা হয়েছে। এদিন সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত গড়ে ভোট পড়েছে ৮৭.৮৮ শতাংশ। অপরদিকে, এদিনের ভোটে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন খণ্ডঘোষ ব্লকের তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অপার্থিব ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, বিরোধীরা হারছে জেনেই মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে। তিনি স্বীকার করেছেন খণ্ডঘোষ বিধানসভায় ১১টি বুথে আধা সামরিকবাহিনী ছিল না। অপরদিকে, বিজেপির ব্লক সভাপতি অরূপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ২৭১টি বুথের মধ্যে অধিকাংশ জায়গাতেই তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি এজেণ্টদের মারধর করে তাড়িয়ে দিয়ে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে। এমনকি পোলিং ও প্রিসাইডিং অফিসাররাও দাঁড়িয়ে থেকে এই ছাপ্পা ভোটে সাহায্য করেছে। তিনি জানিয়েছেন, প্রায় ২০টি জায়গায় বিজেপি কর্মীদের প্রাণনাশের হুমকি এবং মারধর করা হয়েছে। এদিনের ভোট সম্পর্কে সিপিএমের কৃষকসভার জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য বিনোদ ঘোষ জানিয়েছেন, তৃণমূল কংগ্রেস সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ছাপ্পা ভোটের উত্সব পালন করেছে। প্রায় ৩০টিরও বেশি বুথে এদিন আধা সামরিকবাহিনী ছিল না। তিনি জানিয়েছেন, বহু জায়গায় সিপিএমের এজেণ্টদের তাড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের ছেলেদের সিপিএমের এজেণ্ট হিসাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, এরই মাঝে কোথাও কোথাও সিপিএমের সমর্থকরা দাঁতে দাঁত চেপেই শাসকদলের প্রতিরোধ করেছেন। যদিও এদিন বিজেপির ব্লক সভাপতি অরূপ ভট্টাচার্য আশংকা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, শাসকদলের শতবাধা, হুমকিকে উপেক্ষা করেও যেভাবে বিজেপির সমর্থকরা ভোটে লড়াই করেছেন ভোট মিটতেই তাঁদের হুমকি দেওয়া শুরু হয়েছে।