বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- পূর্ব বর্ধমান জেলার ৪ টি মহকুমার মধ্যে বর্ধমান সদর উত্তর ও দক্ষিণ মহকুমা এলাকায় চাষীদের দুশ্চিন্তা ক্রমশই বাড়তে শুরু করল বাদামী শোষক পোকার আক্রমণে। স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষতির জেরে এবারে ধানের উত্পাদন ব্যাপকভাবেই মার খাওয়ার আশংকা তৈরী হল। গলসীর বেলগড়িয়া এলাকার চাষী শম্ভূনাথ মণ্ডল জানিয়েছেন, তাঁরা চার ভাই ৩০ বিঘা জমিতে লাল স্বর্ণ ধানের চাষ করেছেন। বাদামী শোষক পোকার আক্রমণের জেরা জমিতে বিশাল ক্ষতি হওয়ায় ধান কেটে নিয়েছেন ঠিকই কিন্তু পোকায় শেষ করে দিয়েছে। বিঘায় চার বস্তা (৬০কেজিতে ১ বস্তা) করে ধান পাচ্ছেন। অথচ এবারে যা ফলন হয়েছিল তাতে এক বিঘায় ১৮ থেকে ২০ বস্তা ধান হত। তিনি জানিয়েছেন, গত বছর বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছিল। বিঘাতে ১০ থেকে ১২ বস্তা পাওয়া গেছিল। কিন্তু এবার বাদামী শোষক পোকার জন্য চার বস্তার বেশি পাওয়া যাবে না। গলসীর খানো গ্রামের চাষী চৌধুরী গোলাম মইউদ্দিন জানিয়েছেন, এবার তিনি ২ একর জমিতে চাষ করেছেন। গত বছর বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছিল। এবার পোকায় ধান নষ্ট হয়েছে ব্যাপক ভাবেই। আশা করছেন বিঘা প্রতি ৮ থেকে ১০ বস্তা করে ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু ১৫ থেকে ২০ বস্তা করে ধান পাওয়ার আশা ছিল। একইকথা বলেছেন খণ্ডঘোষের দইচাঁদা গ্রামের চাষী রতন কাজী, ধলা খোন্দেকার প্রমুখরা। পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ ইসমাইল জানিয়েছেন, গত বছর ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল। এবছর ৩ লক্ষ ৭৬ হাজার হেক্টরে চাষ হয়েছে। অনাবৃষ্টির জন্য ৮ হাজার হেক্টর চাষ কম হলেও ফলন ভালো হয়েছে। কিছু এলাকায় পোকার সমস্যা হয়েছে। কৃষি দপ্তর যথাসময়ে কীটনাশক ব্যবহার করতে বলেছিল। চলতি সময়ে ধান কাটা হচ্ছে। এখন আর কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না। তাড়াতাড়ি কেটে নিতে হবে। তিনি জানিয়েছেন, যে সমস্ত চাষীরা বীমা করিয়েছেন, তাঁরা বীমার সুবিধা পাবেন। অন্যদিকে, এব্যাপারে জেলা কৃষি দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর আশীষকুমার বাড়ুই জানিয়েছেন, এবছর আউশ ও আমন সহ মোট ৩ লক্ষ ৭৪ হাজার হেক্টরে চাষ হয়েছে। এবার জলের অভাবে প্রায় ১ মাস পর্যন্ত চাষ পিছিয়ে যায়। কিন্তু চাষ হওয়ার পর গাছের চেহারা দেখে বোঝা গেছে ফলন ভালো হবে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে কিছু জায়গায় বাদামী শোষক পোকার আক্রমণে কিছু জায়গায় পুড়ে গেছে বা ফলন কম হয়েছে বলে চাষীরা জানাচ্ছেন। সবমিলিয়ে গোটা জেলায় ৩ থেকে ৪ শতাংশ জমিতে এই আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু সেটাও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু জায়গায়। তিনি জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে ৪০ শতাংশের বেশি জমিতে ধান কাটা হয়ে গেছে। তিনি জানিয়েছেন, চাষীদের তাঁরা আগেই সতর্ক করেছিলেন পোকার আক্রমন হলে এবং ধান ৮০ শতাংশ পেকে গেলেই তা কেটে নিতে হবে। সেই পরামর্শ মেনে অনেকেই কেটে নিচ্ছেন। পোকার আক্রমণের বিষয় সম্পর্কে আশীষবাবু জানিয়েছেন, এই পোকার আক্রমণের কারণ খুব ঘনভাবে গাছ রোয়া। তিনি জানিয়েছেন, বেশি ফলন পাওয়ার আশায় কৃষকেরা ঘনভাবে গাছ লাগিয়েছেন। ফাঁক ফাঁক করে গাছ লাগালে এবং পটাশ সার ঠিকঠাক মত দিলে তাহলে এতটা সমস্যা হত না। তবে এতে জেলার মোট উত্পাদনে তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না। দু-এক জায়গায় একটু ঘাটতি থেকে যেতে পারে। তিনি জানিয়েছেন, ধারাবাহিকভাবে চাষীরা লাল স্বর্ণ গোত্রের ধান চাষ করায় পোকাদের সুবিধা হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে আবহাওয়াজনিত সুবিধা। তিনি জানিয়েছেন, বাদামী শোষক পোকা যখন প্রথম এসেছিল তখন এটা মারাত্মক কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু আসতে আসতে এতবেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে যে সমস্যা তৈরী হয়ে গেছে। এই সমস্ত কীটনাশক জমির উপকারী জীবানু, পোকাদের শেষ করে দিচ্ছে। মাকড়সা-সহ এই সমস্ত উপকারী পোকামাকড়-ই ক্ষতিকারক পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করে দিতো। আশীষবাবু জানিয়েছেন, পোকার আক্রমণের এই সমস্যা কালনা বা কাটোয়া মহকুমায় নেই। সদর উত্তর ও দক্ষিণ মহকুমার কিছু ব্লকগুলেই এই সমস্যা দেখা গেছে। জলীয়ভাব এবং গরম থাকলে এই পোকার বংশ বিস্তারে সুবিধা হয়। ফলে যে সমস্ত জমিতে জল ছিল সেখানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, গোটা জেলার প্রায় ৪ লক্ষ চাষী বিমার আওতায় রয়েছেন। আবেদন করলে বিমা কোম্পানী তাদের নিয়ম অনুযায়ী খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে।