ভীষণ ভয়ংকর, চোখে দেখা যায় না, জীবনে ট্রেনে চাপবো না – বর্ধমান স্টেশনে পা রেখেই জানালেন মৌসুমি ঘোষ
admin
বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- ভীষণ ভয়ংকর, চোখে দেখা যায় না, জীবনে ট্রেনে চাপবো না। এমনই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে সোমবার গভীর রাতে বর্ধমানে বাড়ি ফিরলেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের অনেক যাত্রীই। গভীর রাত, ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১ টা ২৫ মিনিট (১৯ জুন)। আর সেই সময় বর্ধমান স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে ঢোকে ডাউন শিয়ালদা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। ট্রেন ঢোকার অনেক আগে থেকেই যাত্রীদের আত্মীয় পরিজনেরা একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন জেলা প্রশাসনের আধিকারিক, জিআরপি ও পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশের আধিকারিকরাও। পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস থামতেই দেখা যায়, কোনোরকমে জীবন নিয়ে বাড়ি ফেরা যাত্রীদের তখনও চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। সারাদিনের উৎকণ্ঠা, ক্লান্তি নিয়ে নামছেন একের পর এক যাত্রীরা। উৎকণ্ঠায় ছিলেন পরিবার পরিজনরাও। আর এমতাবস্থায় যাত্রী ও তাঁদের পরিবার পরিজনদের জন্য সর্বস্তরের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসন, জিআরপি ও পুলিশ। একরাশ আতঙ্ককে সঙ্গে নিয়েই জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বাড়ি ফেরেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রী থেকে পরিজনেরা। পূর্ব বর্ধমান জেলা বিপর্যয় ব্যবস্থাপন দপ্তরের আধিকারিক প্রতীক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, জেলাশাসক কে. রাধিকা আইয়ারের নির্দেশে জেলাপ্রশাসনের তরফে দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রীদের বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্য ১৩ টি গাড়ি-সহ প্রাথমিক ভাবে সমস্ত রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানীয় জল, প্রাথমিক চিকিৎসার ও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়। জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে রানীগঞ্জ, আসানসোল, দুর্গাপুর, আরামবাগ, কাটোয়া, হুগলি ও গোঘাট-সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৩৪ জন যাত্রীকে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। এদিন বর্ধমানের জামালপুরের বাসিন্দা মৌসুমি ঘোষ বর্ধমান স্টেশনে নেমেও কার্যত দিশাহারা অবস্থা কাটেনি। জানিয়েছেন, আসামের কামাখ্যা গিয়েছিলেন ঘুরতে। দুর্ঘটনার চিত্র এখনও চোখের সামনে সব ঘুরছে। এর আগেও ট্রেনে চেপেছেন। কিন্তু আর না। আর ট্রেনে চাপবেন না। কি ভীষণ ভয়ংকর ঘটনা। ভুলতে পারছেন না। দুর্ঘটনাগ্রস্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের এস-৪ কামরায় ছিলেন দুর্গাপুরের বাসিন্দা সন্দীপন চৌধুরি। বর্ধমান স্টেশনে নেমে তিনি জানিয়েছেন, রেলের গাফিলতির জন্যই এই ঘটনা। একই লাইনে কীভাবে দুটি ট্রেন এল? -প্রশ্ন তুললেন তিনি। অপরদিকে, ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে গুসকরার বিউটি বেগমের। এক নিমেষে বাড়িতে আনন্দের পরিবেশ পরিণত হয়েছে বিষাদের সুরে। সোমবার ছিল ইদুজ্জোহা। আর তাতেই শামিল হয়ে পরিবারের সাথেই থাকতে চেয়ে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে তড়িঘড়ি ট্রেন ধরেছিলেন বিউটি। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বিউটির নিজ বাড়ি গুসকরায় আসার কথা ছিল হলদিবাড়ি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে। তা সোমবার বাতিল থাকায় বিউটির স্বামী বলেছিলেন মঙ্গলবার যাওয়ার কথা। কিন্তু উৎসবের দিনে নিজের পরিবারের সাথেই থাকতে চেয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরায় উঠেছিলেন তিনি। স্বামীকে ফোন করে বলেছিলেন ট্রেন ছেড়েছে, সিট পেয়েছেন তিনি। তারপরই আসে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার খবর। জলপাইগুড়ি থেকে ১৮ কিমি দূরত্বে ঘটনাস্থলে বেলা ১২ টার কিছু সময় পর পৌঁছান বিউটির স্বামী ও তাঁর সহকর্মী শেখ তারিক আনোয়ার। এরপরই তাঁরা সেখানে বিউটির খোঁজ না পেয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিকেলে পৌঁছান, জরুরি বিভাগে খুঁজে না পেয়ে, বিউটির ছবি দেখে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ পরিবারকে জানায় বিউটির মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকেই ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় তাঁর দেহ হাসপাতালের মর্গে আসে। পরে মর্গ থেকেই তাঁর স্বামী বিউটির দেহ শনাক্ত করেন। শেখ আনোয়ার জানিয়েছেন, সারাদিন ধরে দিদিকে খুঁজে বেড়িয়েছি, কিন্তু পাইনি। ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে গিয়ে বার বার করে দেখার পর অবশেষে হাসপাতালের মর্গে দিদির দেহ দেখতে পাই। রেলের তরফে থেকে সাহায্য হিসেবে কিছুই পাইনি, রাজ্য পুলিশ যদিও বা অল্প কিছু সাহায্য করে। তাঁরা ব্যক্তিগত গাড়িতে করেই মৃতদেহ নিয়ে আসতে চাইলে মাটি দেওয়া থানার পুলিশ একটি চালান দেয় । কিন্তু রেলের তরফে কোনো সাহায্য বা সদর্থক ব্যবহার পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, রেলের এহেন ব্যবহারে তাঁরা খুশি হবেন কী করে। পাড়া-প্রতিবেশীদের গুনগুনানিতেই শোনা গেল একটা জীবনের দাম মাত্র কয়েক লাখ টাকায় মেলানো যায়? এভাবে আর কতদিন যাত্রী নিরাপত্তার প্রশ্ন শিকেয় তুলে, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের অঙ্ক দিয়ে হিসাব মেলাবে ভারতীয় রেল?