গণেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- অবশেষে পুলিসের জালে চেন কিলার। রবিবার বিকালে তাকে কালনা থানার সাতপুকুর এলাকা থেকে পুলিস গ্রেপ্তার করে। ধৃতের নাম কামরুজ্জামান সরকার। মুর্শিদাবাদে তার আদি বাড়ি। বছর দু’য়েক ধরে সে নাদনঘাটের সুজননগরে পরিবার নিয়ে থাকে। ভাঙাচোরা জিনিসপত্র কেনা-বেচা করে সে। পুলিসের দাবি, জেরায় কয়েকজন মহিলাকে খুন এবং আরও কয়েকজন মহিলার উপর হামলায় জড়িত থাকার কথা ধৃত কবুল করেছে। তাকে নিয়ে রাতেই বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিস।
পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, ২১ মে সন্ধ্যায় কালনার গোয়ারা গ্রামে ভাড়াবাড়ি থেকে পুতুল মাঝির রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার হয়। মৃতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। সাড়াশব্দ না পেয়ে প্রতিবেশীরা ঘরে ঢুকে তাঁর মৃতদেহ মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখেন। সেই ঘটনায় কামরুজ্জামান জড়িত বলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছে পুলিস। সেই ঘটনায় এদিন তাকে হেফাজতে নেয় পুলিস। এর আগে ৮ এপ্রিল কালনায় এক মহিলাকে খুনের চেষ্টা করা হয়। ঘটনার দিন কালনার রংপাড়ার স্বরূপা বিবি তাঁতের কাজ করছিলেন।
এ বছরেরই ২ এপ্রিল কয়েকঘন্টার ব্যবধানে মেমারি থানার বড়া ও সাতগেছিয়া গ্রামে দুই মহিলাকে খুন করা হয়। বড়া গ্রামের সিদ্ধেশ্বরপাড়ার রীতা রায় বাড়িতে একা ছিলেন। বেলা ২টো নাগাদ তাঁর মেয়ে শোভা বিশ্বাস বাড়িতে এসে মায়ের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। মৃতার গলায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাতের লক্ষণ ছিল। সেদিনই সাতগেছিয়ার সেগুনবাগানের কাছে বাড়ি থেকে মমতা কিস্কুকে (৫০) রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মেমারির পাহাড়হাটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মাথাতেও ভারি কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। সব ক’টি ঘটনাতেই চেন কিলারের যোগ রয়েছে বলে সন্দেহ করেন বাসিন্দারা।
এর আগে মেমারি থানার জাবুইডাঙায় ঘর থেকে সোনি যাদবের (১৯) মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি চেন উদ্ধার হয়। এর আগে ২ ফেব্রুয়ারি কালনার উপলতি গ্রামে এক বৃদ্ধার উপর হামলা চালায় দুষ্কৃতিতে। সেই সময় ছেলে চলে আসায় দুষ্কৃতি দৌড়ে পালায়। বেঁচে যান বৃদ্ধা। বৃহস্পতিবার কালনার সিঙ্গেরকোণে এক নাবালিকার উপর হামলা হয়। ধর্ষণের পর তাঁকে খুনের চেষ্টা করা হয়। হুগলির বরাগড়েও একই কায়দায় এক মহিলা খুন হন।
পরপর খুনের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়ায় বাসিন্দাদের মধ্যে। প্রশ্নের মুখে পড়ে পুলিসের ভূমিকা। খুনিকে ধরতে নানাভাবে চেষ্টা চালায় পুলিস। বিভিন্ন জায়গা থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে সম্ভাব্য খুনিকে শনাক্ত করার চেষ্টা চালায় পুলিস। এছাড়াও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে শিল্পীকে দিয়ে খুনির ছবি আঁকায় পুলিস। তা বিভিন্ন থানায় এবং সিভিক ভলান্টিয়ারদের দেওয়া হয়। বিভিন্ন সূত্র মারফত পুলিস জানতে পারে, খুনি একজনই। সে বাইকে চেপে এসে অপারেশন সেরে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে। রবিবার এক সিভিক ভলান্টিয়ার কালনার সাতপুকুর এলাকায় বাইকে চেপে যাওয়ার সময় কামরুজ্জামানকে ধরে। তার কাছে থাকা ব্যাগ থেকে চেন ও রড মেলায় সিভিক ভলান্টিয়ারের সন্দেহ হয়। তিনি থানায় খবর দেন। এরপর কামরুজ্জামানকে থানায় নিয়ে গিয়ে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিস। জিজ্ঞাসাবাদে ভেঙে পড়ে সে ৬টি খুনে এবং সমসংখ্যক হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। মেমারির দেবীপুরে অপারেশন সারতে সে যাচ্ছিল বলে পুলিসকে জানায় কামরুজ্জামান। জেলা পুলিশ সূত্রে জানাগেছে, চুরির উদ্দেশ্য নয়, নেশা চাপলেই খুন করে কামরুজ্জামান। কালনা, মন্তেশ্বর, মেমারি ও হুগলির পাণ্ডুয়া ও বলাগড়ের ৬টি খুনের ঘটনায় সে জড়িত। আরও কয়েকটি খুনের চেষ্টাতেও সে জড়িত। ৩ বার সে খুনের ধরণ পাল্টেছে। প্রথমে মিটার দেখার নাম করে ঘরে ঢুকে সে খুন করত। টার্গেট হিসাবে সে মহিলাদের বেছে নেয়। খুনের আগে সে এলাকায় বেশ কয়েকবার রেইকি করত। তারপর মহিলাকে একা পেলেই অপারেশন সারত। কয়েকটি ক্ষেত্রে বাড়িতে লোক থাকায় সে ব্যর্থ হয়। কোনও রকমে পালায় সে। ৩ বার ব্যর্থ হওয়ার পর সে খুনের ধরণ বদলায়। মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করে খুন করার পদ্ধতি সে বেছে নেয়। পরে ধরণ বদল করে ধর্ষণের পর মহিলাদের চেন পেঁচিয়ে ও মাথায় রড দিয়ে আঘাত করে খুন করতে শুরু করে সে। এর আগে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি কালনার ধাত্রীগ্রামের প্রৌঢ়া পূর্ণিমা গঙ্গোপাধ্যায় এবং সেই বছরেরই ২৭ জানুয়ারি মন্তেশ্বরের কুঁড়েপাড়ার সাধনা চট্টোপাধ্যায়কে খুনের ঘটনাতেও সে জড়িত বলে কামরুজ্জামান স্বীকার করেছে। ধৃতকে বিভিন্ন মামলায় হেফাজতে নিয়ে সব ক’টি ঘটনার পুননির্র্মাণ করা হবে।