বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- গাড়ির ডিকির ভিতর হাত-পা বেঁধে ও গলায় প্লাস্টিকের স্ট্রিপ লাগানো অবস্থায় অপহৃত শিশুকে নিয়ে তার বাবার সঙ্গে থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিল শক্তিগড়ে অপহরণ কাণ্ডে ধৃত শেখ জামির হোসেন ওরফে রাজ। ওই অবস্থায় বিভিন্ন জায়গায় অপহৃতের খোঁজেও যায় জামির। সে-ই অপহরণের মূল পাণ্ডা। ঘটনায় অপর ধৃত শেখ রবিউল ওরফে সুলতানকে কিভাবে হিন্দিতে মুক্তিপণ চেয়ে ফোন করতে হবে তাও সে-ই শিখিয়েছে। কয়েকদিন ধরে কণ্ঠস্বর ভারি করে কিভাবে ফোন করতে হবে সুলতানকে তার তালিম দিয়েছে জামির। অপহরণে আরও কয়েকজন জড়িত বলে প্রাথমিক জেরায় পুলিসকে সে জানায়। যদিও তা ঠিক নয় বলে জানতে পেরেছে পুলিস। পুলিসকে বিভ্রান্ত করতে অপহরণে আরও কয়েকজনের জড়িত থাকার কথা বলে সে। জেরার সময় পুলিসকে ভুল-ভাল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে জামির। এমনকি জেরার সময় পুলিস সুপারকেও বোকা বানানোর চেষ্টা করে সে। অপহরণে দ্বিতীয় গাড়ি ব্যবহারের তথ্য তুলে ধরে পুলিসকে প্রাথমিকভাবে সে বোকা বানায়। তবে, বিভিন্ন জায়গায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে অপহরণে যে দ্বিতীয় গাড়ি ব্যবহার করা হয়নি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে পুলিস। বাবার গাড়িতেই শিশুকে অপহরণ করা হয় বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিস। অপহরণে জামির ও রবিউল ছাড়া অন্য কেউ জড়িত নয় বলে জেনেছে পুলিস। অপহরণের পর শিশুর পরিবারকে নানাভাবে জামির বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। অপহরণের পর শিশুর পরিবারের পাশে থাকায় কারও মনে কোনও সন্দেহ হয়নি। মুক্তিপণের টাকা নিয়ে দুর্গাপুরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতও হচ্ছিল সে। তবে, কাঁদরসোনার ঝোপঝাড় থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্যে অপহৃত শিশু উদ্ধার হওয়ার পরই সে ভেঙে পড়ে। শিশুটি অপহরণে ড্রাইভার আঙ্কেলের নাম করার পর সে নানা যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত পুলিসি জেরায় ভেঙে পড়ে জামির অপহরণে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নেয়।
সোমবার অপহরণের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখায় নি পুলিস। তবে, মঙ্গলবার আদালতের কাজকর্ম শুরু হতেই তদন্তকারী অফিসার শ্রীধর সেন মাদক মামলায় জেলে থাকা জামিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন করেন। সিজেএম রতন কুমার গুপ্তা আবেদন মঞ্জুর করার পর বর্ধমান সংশোধনাগারে গিয়ে জামিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী অফিসার। পুলিস সূত্রে খবর, জেলে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভেঙে পড়ে অপহরণে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নেয় জামির। সে-ই অপহরণের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে বলে স্বীকার করে নেয় জামির। তার কথামতোই সুলতান কেবলমাত্র মুক্তিপণ চেয়ে হিন্দিতে ফোন করে বলে কবুল করে নেয় সে। বিকালে অপহরণ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন জানান তদন্তকারী অফিসার। ধৃতকে ২২ অক্টোবর আদালতে পেশ করার জন্য নির্দেশ দেন সিজেএম। সেদিনই গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদনের শুনানি হবে। কেস ডায়েরি নিয়ে তদন্তকারী অফিসারকে হাজির থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
রবিবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ নিখোঁজ হয় শক্তিগড় থানার আমড়ার ল্যাংচা ব্যবসায়ী বলিরাম ওঝার ৫ বছরের ছেলে অনীশ। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি লাল রংয়ের গাড়িতে করে তাকে অপহরণ করা হয় বলে সন্দেহ করে পুলিস। বাবারই গাড়িতে করে যে অনীশকে অপহরণ করা হতে পারে তা বিন্দুমাত্র মনে আসেনি পুলিসের। পরে, আশপাশের কয়েকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বাবারই গাড়িতে করে অনীশকে অপহরণ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হয় পুলিস। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, দোকান লাগোয়া বাড়ি থেকে হাঁটিয়ে গাড়িতে তোলা হয় অনীশকে। ক্লোরোফর্ম জাতীয় কিছু দিয়ে তাকে অজ্ঞান করা হয়। এরপর হাত-পা বেঁধে ও গলায় প্লাস্টিকের স্ট্রিপ বেঁধে তাকে গাড়ির ডিকিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তারপর গাড়ি নিয়ে অপহৃতের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যায় সে। এমনকি থানায় অভিযোগ জানাতেও গাড়িটি নিয়েই যায় সে। জিজ্ঞাসাবাদে জামির জানিয়েছে, কিছুদিন ধরেই অনীশকে অপহরণের ছক কষেছিল সে। পরিকল্পনা সফল করতে শিশুর বাবার কাছে গাড়ি চালানোর কাজ নেয় জামির। এমনকি কাঁদরসোনার যেখান থেকে শিশুটি উদ্ধার হয়েছে সেখানেও বলিরামকে কয়েকদিন গাড়ি চালানো শেখাতে নিয়ে গিয়েছিল সে। জায়গাটি চেনা হওয়ায় অপহরণের পর অনীশকে সেখানকার ঝোপঝাড়ে ফেলে দিয়ে যায় সে। পুলিস আরও জেনেছে, ঘটনার দিন মুক্তিপণ চেয়ে ফোন করার জন্য সুলতানকে ২০০ বারের বেশি ফোন করে চাপ দেয় জামির। প্রথমে মুক্তিপণ চেয়ে ফোন করতে রাজি হয়নি সুলতান। চাপ দিয়ে তাকে ফোন করতে বাধ্য করা হয়। পরিকল্পনামাফিক সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু, মুক্তিপণ চেয়ে আসা ফোনের সূত্র ধরে পুলিস তদন্ত শুরু করতেই ভেঙে পড়ে জামির। ঘোরানোর নাম করে গাড়ি নিয়ে কাঁদরসোনায় গিয়ে সে অনীশকে ফেলে আসে। মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার পর অনীশের হদিশ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। এদিকে উদ্ধার হওয়ার পর বর্ধমান মেডিক্যাল হাসপাতালে ভরতি করা হয় অনীশকে। এদিন হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে যেভাবে ফেলে রাখা হয়েছিল তাতে সে মারা যেতে পারত। তাই, মামলায় এখনও মেরে ফেলার চেষ্টার ধারা যুক্ত না হওয়ায় বিস্মিত আইনজীবী মহল। শক্তিগড় থানার এক অফিসার বলেন, শিশুটির চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি হাসপাতাল থেকে নেওয়ার পর খুনের চেষ্টার ধারা যুক্ত করার জন্য আদালতে আবেদন জানানো হবে।