E Purba Bardhaman

বর্ধমান মেডিকেল কলেজে ‘থ্রেট সিন্ডিকেট’, অভিযুক্তের কুশপুতুল দাহ; আইনি পদক্ষেপের ভাবনা

Some doctors were accused of threatening the students of Burdwan Medical College.

বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- এবার থ্রেট সিন্ডিকেট নিয়ে নাম জড়ালো বর্ধমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের। এই ঘটনায় ব্যাপক হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। আরজি কর কাণ্ডের পরে সোশ্যালমিডিয়ার বিভিন্ন গ্রুপে ‘থ্রেট সিন্ডিকেট অ্যাট বিএমসিএইচ’ পোস্টার ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানেই চিকিৎসক অভীক দে-র নেতৃত্বে কয়েকজন চিকিৎসক ও প্রাক্তনী ‘চক্র’ চালায় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ওই পোস্টারে প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুহৃতা পালেরও ছবি রয়েছে। নাম এসেছে চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাসেরও। জানাগেছে, চিকিৎসক অভীক দের বাড়ি পূর্ব বর্ধমান জেলার নারায়নদিঘি এলাকায়। তিনি এসএসকেএম-এর চিকিৎসক। ঘটনার দিন আর জি করে অভীক দেকে (লাল গেঞ্জি) দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ। অন্যদিকে, চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাস বর্ধমান মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট। বর্ধমান মেডিকেল কলেজের প্রাক্তনীদের দাবি, “আমরাও সমাজমাধ্যমে ওই পোস্টার দেখেছি। তাতে আমরা চিন্তিত। আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এভাবে সামাজিকভাবে হেনস্তা ও কালিমালিপ্ত হতে হবে ভাবিনি। মিথ্যা অভিযোগ করে যে ভাবে ছবি ছড়ানো হয়েছে, তাতে এই কাজ যাঁরা করছেন, তাঁরা মানসিকভাবে ধর্ষক বলেই মনে হচ্ছে।” সুহৃতা পালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর জবাব মেলেনি। স্বাস্থ্য-দুর্নীতিতে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’ জড়িয়ে আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বার সেই তালিকায় যোগ হল, ‘বর্ধমান লবি’। চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতার স্বাস্থ্য দফতর পর্যন্ত যে দুর্নীতি-চক্র গড়ে উঠেছে, তার অন্যতম নিয়ন্ত্রক হল ‘বর্ধমান লবি’। যাঁকে ঘিরে এই ‘লবি’, তিনি বর্ধমানের বাসিন্দা হলেও এমবিবিএস করেছেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ থেকে। তিনি বর্ধমানে রেডিয়োলজিতে আরএমও হিসেবে যোগ দেওয়ার পরেই বর্ধমান লবি ডানা মেলতে শুরু করে বলে অভিযোগ। চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, করোনা-কালের সময় থেকেই ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র প্রশ্রয়েই রাজ্যের বুকে ‘বর্ধমান লবি’ জায়গা করে নিতে থাকে। সেই সময়ের কলেজ অধ্যক্ষ সুহৃতা পাল থেকে পরের অধ্যক্ষরাও ‘বর্ধমান লবি’র কথা শুনেই কলেজ পরিচালনা করতেন। বর্ধমান মেডিকেল কলেজ থেকে রাজ্যের স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন সুহৃতা পাল। বর্ধমান লবিরও বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়ে যায়। পড়ুয়া থেকে চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, বর্ধমান মেডিকেল কলেজ, সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ-সহ রাজ্যের ৫ টি মেডিকেল কলেজের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ‘বর্ধমান লবি’। এমনকি বর্ধমান মেডিকেল কলেজে আরএমওকে উত্তরবঙ্গ মেডিকেলে পরীক্ষার পর্যবেক্ষকও করা হয়েছিল। রাজ্য স্বাস্থ্য-প্রশাসনের অন্দরের দুর্নীতির ‘লবি’তে বর্ধমানের নাম জড়ান নিয়ে চিকিৎসক সংগঠনের দাবি, ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র শীর্ষ কর্তার আশীর্বাদ নিয়ে বর্ধমান মেডিকেলে আরএমও হয়ে আসেন স্থানীয় নারায়নদিঘির বাসিন্দা অভীক দে। তিনি তৃণমূলপন্থী দু’তিনজন চিকিৎসককে নিয়ে প্রথমে গোষ্ঠী তৈরি করেন। পরীক্ষাও নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে দেন বলে অভিযোগ। ডানা মেলার পরে চিকিৎসকদের পোস্টিং’য়েও ‘বর্ধমান লবি’র নাম উঠে আসে। এক চিকিৎসক বলেন, “বর্ধমান-লবি সক্রিয় হওয়ার পরে বর্ধমান মেডিকেলে বাইরের কেউ অধ্যক্ষ বা সুপার পদে আসেননি। বরং বর্ধমান মেডিকেল থেকেই অন্য জায়গাতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন চিকিৎসকরা।” আর এবার আরজি কর কাণ্ডের পরে সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে ‘থ্রেট সিন্ডিকেট অ্যাট বিএমসিএইচ’ পোস্টার ছড়িয়ে পড়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর যুগ্ম সম্পাদক সুবর্ণ গোস্বামীর অভিযোগ, “উত্তরবঙ্গ থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্ধমান-সহ ৫টি মেডিকেলে ‘সিন্ডিকেট’ চালায় অভীকরা। পরীক্ষা ব্যবস্থা, পোস্টিং থেকে নানাবিধ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। অভীক এতটাই শক্তিশালী যে ২০২৩ সালে কোভিড না-থাকার পরেও কোভিডের বিশেষ কোটায় এসএসকেএমে স্নাতকোত্তর করার সুযোগ পেয়েছে।” ওই চিকিৎসক সংগঠনের দাবি, ওই ‘লবি’র সঙ্গে যুক্তরা প্রথম শ্রেণিতে পাশ করে, হাউসস্টাফের সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু ‘লবি’র বিরোধিতা করলেই ফেল করার ভয় দেখায়। এদিকে, এই ঘটনায় শুক্রবার রাত থেকেই বর্ধমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা এই থ্রেট কালচার নিয়ে ব্যাপকভাবেই সরব হতে শুরু করেছেন। তাঁরা স্লোগান দেন – “থ্রেট কালচারের এর গালে গালে, জুতো মারো তালে তালে!” এদিন এক জুনিয়র ডাক্তার জানিয়েছেন, এখানে ৪-৫ বছর ধরে ভয়ের বাতাবরণ রয়েছে। শুধু ভয়ের বাতাবরণই নয় হাউস স্টাফ কাউন্সেলিং থেকে শুরু করে পরীক্ষা পদ্ধতি, রেজাল্ট সমস্ত ক্ষেত্রেই দুর্নীতি রয়েছে। শুনেছি এই দুর্নীতির সঙ্গে উত্তরবঙ্গ লবির সেই চিকিৎসক যাকে ওই ঘটনার দিন দেখা যাচ্ছে তিনি জড়িত। তিনি জানান, তাঁদের অভিযোগের জলজ্যান্ত প্রমাণ শুক্রবারের জিবি মিটিং-এ উঠে আসে। এই থ্রেট কালচারের প্রতিবাদে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টরা যারা কোনও রাজনৈতিক দল করেন না, যারা ডাক্তারি পড়তে, ডাক্তারি শিখতে এসেছেন তাঁরা একত্রিত হয়ে সরব হয়েছেন। এই থ্রেট কালচার, এই দুর্নীতি, ভয়ের বাতাবরণের পরিবেশ বর্ধমান মেডিকেল কলেজে তাঁরা আর সহ্য করবেন না। এর একটা সুষ্ঠু সমাধান হোক। এর বিচার হোক। এবং একটা মুক্তচিন্তার পরিবেশের দিকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ এগিয়ে যাক। শনিবার এই বিষয়ে অধ্যক্ষ এবং এমএসভিপি-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। কোনও ভাবেই থ্রেট এলেই সবাই একসাথে সরব হবেন। ছাত্রছাত্রীরা এতদিন বলতে পারেন নি। এখন তাঁরা মুখ খুলছেন। তিনি জানিয়েছেন, আর জি কর কান্ড নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে চলতে থাকা আন্দোলন প্রভাবিত করার চেষ্টাও এই বর্ধমান লবি করছে। এতদিন আন্দোলনের স্বার্থে তাঁদেরকে চিহ্নিত করা হয়নি। গতকালের জিবি মিটিং-এ যেভাবে গুন্ডামি, হুমকি, অভব্য ভাষায় আক্রমণ করা, ব্যক্তিগত আক্রমণ করা এবং ধর্ষক তকমা দেওয়া হয়েছে সেই বিষয়গুলিকে তাঁরা তীব্রভাবে প্রতিবাদ করছেন। তাঁরা এতটাই আতঙ্কিত বিষয়টি নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও ভাবছেন। জিবিতে বহিরাগতরা ছিলেন। কয়েকবছর আগে পাস করে গেছেন এমন, যাঁদের সঙ্গে বর্তমানে এই মেডিকেল কলেজের কোনও সম্পর্ক নেই তাঁরা ছিলেন। এব্যাপারে বর্ধমান মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মৌসুমি ব্যানার্জ্জী জানিয়েছেন, আমার জানা ছিল না। আজ স্মারকলিপি পেয়েছি। নিশ্চয়ই দেখবো। অভিযোগের তদন্ত করে দেখতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে কলেজ কাউন্সেলিং মিটিং ডাকা হয়েছে, এটা নিয়ে আলোচনা হবে। এটা একদম বাঞ্ছনীয় নয়। সবাই পড়াশুনা করতে এসেছে, সেই পরিবেশ রাখতে হবে। অভিক দে প্রসঙ্গে অভিযোগ এসেছে সেটাও দেখা হবে। অভিযোগ যে কেউ করতে পারেন, সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে। অভিক দে বর্ধমান মেডিকেল কলেজের সাথে যুক্ত নয়। তাঁর বন্ধু বান্ধব এখানে থাকতে পারেন, সেক্ষেত্রে সে আসতে পারেন। তবে মিটিং করতেন কিনা তদন্ত করে দেখতে হবে। অন্যদিকে, থ্রেট কালচারের প্রতিবাদে শনিবার রাতে বর্ধমান মেডিকেল কলেজে বিক্ষোভে সামিল হন চিকিৎসক ও ডাক্তারি পড়ুয়ারা। অভীক দে এবং ধর্ষকের কুশপুতুলও পোড়ানো হয় এদিনের বিক্ষোভে।

Exit mobile version