E Purba Bardhaman

বৃষ্টির ঘাটতিতে পুকুরে জলের অভাবে শোলা চাষ কম হওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন শোলাশিল্পীরা

Sponge-wood cultivation has been reduced due to lack of rain water in the pond. Sponge-wood artist is in trouble. At Bankapai, Katwa in Purba Bardhaman

কাটোয়া (পূর্ব বর্ধমান) :- চলতি বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ায় একদিকে যেমন প্রথাগত চাষ বিশেষত ধান চাষের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তেমনি জলের অভাবে এবছর শোলা শিল্পেও নেমে এসেছে গভীর সমস্যা। সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় এবং এবারে শোলার চাষও সঠিকভাবে না হওয়ায় শোলার দামও লাফিয়ে কয়েকগুণ বাড়ায় চলতি পুজোর সময় বর্ধমানের বনকাপাসির শোলা শিল্পীদের মাথায় হাত। আর তাই এবারে শোলা তথা ডাকের কাজের চাহিদা থাকলেও শিল্পীরা তেমনভাবে যোগান দিতে পারছেন না। মঙ্গলকোটের কৈচড় ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বনকাপাশীর শোলা শিল্পী প্রশান্ত ব্যানার্জী জানিয়েছেন, এই গ্রামে প্রায় ৫০ টা কারখানা আছে। গ্রামের প্রায় ১৫০০ মানুষ এই পেশার সাথে যুক্ত। মুড়ুলে, বৈঁচী, বাজার-সহ কয়েকটি আশেপাশের গ্রাম থেকেও ৪০০-৫০০ জন এই গ্রামে কাজ করতে আসেন। তিনি নিজে প্রায় ৩০ বছর এই পেশায় যুক্ত। পুজোর সাজ ছাড়াও শোলা দিয়ে বিভিন্ন মূর্তি, মডেল তৈরী করেন প্রশান্তবাবু। তিনি জানিয়েছেন, এবছর বাজার ভাল। কিন্তু শোলার যোগান কম। প্রথম দিকে ভয়ে তাঁরা অর্ডারই নেননি। ফলে কলকাতার অনেক মূর্তি শিল্পীই এবার শুধু জরির কাজের কথা ভাবছিলেন। পরে শোলার কাজের অর্ডার নেওয়া শুরু হয়। প্রশান্তবাবু জানিয়েছেন, অনেক অর্ডার ফিরিয়েও দিতে হয়েছে। যদিও তিনি জানিয়েছেন, এই গ্রামের শোলার কাজের অনেক কারখানা মালিক অনেক আগে থেকেই কিছু কিছু শোলা কিনে স্টক করে রেখেছিলেন। সেটাই অনেকের কাছে প্রধান ভরসা। এবারের বেশি দামে শোলা অনেকেই কেনেনি, বা কিনলেও অল্প কিনেছেন। ফলে অর্ডার নেওয়া হয়নি। তবে গ্রামে যা অর্ডার নেওয়া হয়ছে তা গতবছরের থেকে কম নয়। তিনি জানিয়েছেন, তিন রকম শোলা হয়। মোটা, মাঝারি এবং সরু। মোটা ও মাঝারি শোলা আসে দুই ২৪ পরগণা থেকে কলকাতার বিধাননগর-সহ কয়েকটি হাট হয়ে এখানে আনা হয়। সরু শোলা স্থানীয় জলাশয় থেকে সংগ্রহ বা কেনা হয়। আশেপাশের জেলা থেকেও সরু শোলা আসে। তিনি জানিয়েছেন, এবছর বৃষ্টি কম হওয়ার জন্য শোলা চাষ হয়নি। ফলে শোলার যোগান কম। স্থানীয় খাল-পুকুর ১০০ দিনের প্রকল্পে সংস্কার হওয়ার পর সেইসব জায়গায় চাষ ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে যে সরু শোলা হত তা আর হচ্ছে না। তিনি জানিয়েছে্ন, শোলার যোগান কমে যাওয়ায় দুবছর আগে সরু শোলার এক হাত দড়ির বান্ডিলের দাম ছিল ৫০-৬০ টাকা। এখন সেই দাম ২০০ টাকা। মাঝারি শোলার এক হাত দড়ির বান্ডিলের দাম ছিল ২০০ টাকা। এখন সেই দাম ৬০০ টাকা। মোটা শোলার এক হাত দড়ির বান্ডিলের দাম ছিল ৩০০ টাকা। এখন সেই দাম ৮০০-৯০০ টাকা। উল্লেখ্য, প্রশান্তবাবু এবছর দুর্গার শোলার সাজ দিল্লী, লক্ষ্ণৌ, মুম্বাই, ভোপাল যাচ্ছে। যদিও সরকারী উদাসীনতা নিয়ে প্রশান্তবাবু ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সরকার এই শিল্প এবং শিল্পীদের বিষয়ে উদাসীন। বিভিন্ন শিল্পীদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু শোলা শিল্পীদের তা দেওয়া হচ্ছে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালে বনকাপাসিতেই সরকারীভাবে তৈরী হয়েছে শোলা হাব। নামেই শোলা হাব। ওখানে শোলা ছাড়া অন্যান্য ব্যবসা চলে। সাত-আটটা ঘর রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন দোকান খোলা হয়েছে। অথচ বনকাপাসির শোলার কাজ বিশ্বজোড়া হওয়ায় রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এই হাব তৈরীর উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যত তা অন্ধকারেই রয়ে গেছে। প্রশান্তবাবু জানিয়েছেন, শুধুমাত্র সাদা রঙের বদলে ডাকের সাজে এখন বিভিন্ন রঙের ব্যবহারের চাহিদা বেড়েছে। সঙ্গে চুমকি ও জরীও ব্যবহার হচ্ছে। প্রশান্তবাবু জানিয়েছেন, শোলা শিল্পী মৃত্যুঞ্জয় মালাকারের স্ত্রী কাত্যায়নী মালাকার ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পান। মহিরাবণ বধ বানিয়ে ছিলেন। তাঁদের উদ্যোগেই বনকাপাসিতে প্রথম শোলা শিল্পের কাজ শুরু হয়। মৃত্যুঞ্জয় মালাকারের ছেলে আদিত্য মালাকার ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পান। ২.৫ ফুটের অকালবোধন বানিয়েছিলেন। আদিত্যবাবুর ছেলে আশীষ মালাকার ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পান। ৩ ফুট/৩.৫ ফুটের পাঁচ চালির দুর্গা বানিয়েছিলেন। একই পরিবারের তিনপ্রজন্ম রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েছেন। এরই পাশাপাশি আদিত্য মালাকার ২০০৭ সালে ২৯ ইঞ্চির দুর্গা বানিয়ে শিল্পগুরু সম্মান পেয়েছেন। একাধিকবার বিদেশে গেছেন। শোলাশিল্পী জীবন মালাকার ও রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিল্পী আশীষ মালাকারও জানিয়েছেন, শোলার দাম যা বেড়েছে এবছর স্টক শোলা এবং কিছু বেশি দামে কিনে চালিয়ে দেওয়া হলেও সামনের বছর কাজ করাই মুশকিল হয়ে পড়বে। তাঁরা জানিয়েছেন, ৫০০ টাকার শোলা ২৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। গ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ এই কাজে যুক্ত। সারাবছর চাষবাসের অন্যান্য কাজের সঙ্গে এই কাজে যুক্ত থাকলেও আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত এই পাঁচমাস শোলা শিল্পের সঙ্গেই যুক্ত থাকেন। বছরের অন্যান্য সময় মডেল, ডেকোরেশনের কাজ করেন। যদিও মহকুমা শাসকের উদ্যোগে যে সমবায় তৈরী হয়েছে সেই সমবায়ে যোগ দেওয়ার প্রশ্নে শিল্পীরা রীতিমত দ্বিধাবিভক্ত। অনেকেই তাতে যোগ দিতে ভরসা পাচ্ছেন না বলেও জানিয়েছেন। যদিও এব্যাপারে কাটোয়ার মহকুমা শাসক সৌমে্ন পাল জানিয়েছেন, ১২জনকে নিয়ে বনকাপাসিতে একটি সমবায় তৈরী করা হয়েছে। শোলা হাবের কাজ যে সঠিকভাবে হচ্ছে না তা স্বীকার করেই মহকুমা শাসক জানিয়েছেন, আরও শিল্পীকে এই সমবায়ের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 

Exit mobile version