E Purba Bardhaman

খরচের রাশ টানতে পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের গাড়িতে জিপিএস চালুর প্রস্তাব খারিজ

Stock Photo - Purba Bardhaman Zilla Parishad - Photo by Sanjoy Karmakar, Purba Bardhaman

বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদে গাড়িতে জিপিএস বসানোর প্রস্তাব বাতিল হল। কর্মাধ্যক্ষদের প্রবল বাধায় গাড়িতে জিপিএস লাগানোর প্রস্তাব খারিজ হয়। কয়েক বছরে জেলা পরিষদে গাড়ির পিছনে খরচ অনেক বেড়েছে। ৬ বছরে প্রায় ২ কোটি টাকা গাড়ির তেলের পিছনে খরচ হয়েছে। তৃণমূল জেলা পরিষদের দখল নেওয়ার পর ৫ বছরে গাড়ির পিছনে দেড় কোটি টাকার কাছাকাছি খরচ হয়েছে। আর চলতি বোর্ডের ৮ মাসে প্রায় ৩১ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে বলে জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে। এমনিতেই জেলা পরিষদের নিজস্ব তহবিলের অবস্থা ভালো নয়। তাই, গাড়ি ব্যবহারে লাগাম পড়াতে প্রতিটি গাড়িতে জিপিএস বসানোর প্রস্তাব রাখা হয়। জেলা পরিষদের ১৭টি গাড়ির সব ক’টিতেই জিপিএস বসানোর প্রস্তাব রাখা হয়। 
গাড়ির তেল খরচ কমাতে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে যে সমস্ত গাড়ি চলাচল করে তার গতিবিধিতেই নজরদারী চালানোর ওপর জোড় দিয়েছিলেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি শম্পা ধাড়া। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক বিজয় ভারতীও। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের বিভিন্ন আধিকারিক, কর্মাধ্যক্ষ প্রমুখদের গাড়িতে জিপিএস লাগানোর প্রস্তাব দেন সভাধিপতি শম্পা ধাড়া। সূত্রের খবর, এব্যাপারে তিনি নিজের গাড়িতেই প্রথম এই পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন জানান। কিন্তু মৌচাকে ঢিল পড়ার মতই জেলা পরিষদের অর্থ স্থায়ী সমিতির বোর্ড সদস্যদের প্রবল বাধায় কার্যত এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়ে গেল। বৃহস্পতিবার জেলা পরিষদের অর্থ সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে এনিয়ে আলোচনা হয়। সূত্রের খবর, আলোচনা শুরু হতেই কয়েকজন কর্মাধ্যক্ষ রে-রে করে ওঠেন। গাড়িতে জিপিএস বসানোর তীব্র আপত্তি জানান তাঁরা। এক কর্মাধ্যক্ষ নজরদারির জন্য জিপিএস বসানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে সভায় সোচ্চার হন। তিনি বলেন, গাড়িতে জিপিএস কোনও ভাবেই লাগানো যাবে না। আমাদের কি কোনও প্রাইভেসি নেই? গাড়ি নিয়ে আমরা ঘুরতে যাই না। অফিসের কাজ ও দলের কাজের জন্য গাড়ি ব্যবহার করি আমরা। অধিকাংশ সদস্য তাঁকে সমর্থন করেন। জিপিএস বসানোর প্রস্তাব বাতিলের দাবিতে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন তাঁরা। সভায় উপস্থিত জেলা প্রশাসনের এক কর্তা গাড়িতে জিপিএস বসানোর পক্ষে সওয়াল করেন। কর্মাধ্যক্ষদের গাড়ির জন্য তাঁর চেয়ে বেশি কেন তেল লাগে তা জানতে চান তিনি। গাড়িতে জিপিএস বসালে কোনও সমস্যা নেই বলে জানান প্রশাসনের ওই কর্তা। কর্মাধ্যক্ষদের তীব্র আপত্তিতে গাড়িতে জিপিএস বসানোর প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।

বৃহস্পতিবার জেলা পরিষদের অর্থ সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে হাজির ছিলেন খোদ জেলাশাসক বিজয় ভারতীও। সূত্রের খবর, ওই বৈঠকেই জেলা পরিষদের গাড়ির তেল খরচের রাশ টানতে গাড়িতে জিপিএস লাগাতে বাধা দেওয়া হলেও খোদ জেলাশাসক অভিমত ব্যক্ত করেছেন তিনি তাঁর গাড়িতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করবেন। উল্লেখ্য, বর্ধমানে নয়া জেলাশাসক হিসাবে কাজে যোগ দেবার পরই বিজয় ভারতী জানিয়েছিলেন, বহু আধিকারিক যথেচ্ছ গাড়ি ব্যবহার করছেন। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে কই? কার্যত এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই তিনিও যে আধিকারিকদের যথেচ্ছ খরচে লাগাম টানতে চাইছেন তা পরিষ্কার হয়েছে। জেলা পরিষদের বৈঠকে নিজের গাড়িতেই জিপিএস লাগানোর জন্য তিনি নিজেই রাজী হয়ে যাওয়ায় এবার খোদ গোটা জেলা জুড়েই আধিকারিকদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেছে। কারণ কেবলমাত্র জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ বা আধিকারিকরাই নন, অনেকেই সরকারী তেল পুড়িয়ে ব্যক্তিগত বা পার্টির কাজ সারেন। যার জন্য সরকারী তেল বরাদ্দ নেই। উল্লেখ্য, জেলা পরিষদের সভাধিপতি, সহকারী সভাধিপতি ছাড়াও কর্মাধ্যক্ষরা গাড়ি ব্যবহারের খরচ পান। সম্প্রতি জেলা পরিষদে যে মেণ্টর বা সহকারী মেণ্টর নিয়োগ করা হয়েছে তাঁদেরও গাড়ি খরচ এবং নিজস্ব ঘর দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে জেলা পরিষদের আধিকারিকদের বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতে গাড়ির খরচ।
     জেলা পরিষদের গাড়ির খরচ অত্যধিক বেড়ে গিয়েছে। এনিয়ে জেলা পরিষদের সদস্যদের একাংশ সোচ্চার হয়েছেন। এক সদস্য বলেন, গত বোর্ডের আমলে জেলা পরিষদের নিজস্ব তহবিল থেকে গাড়ির তেলের বিল মেটানো হয়। এর পরিমাণ প্রায় ২ কোটি টাকায় পৌঁচেছে। তেল খরচের সেই ধারা কয়েকজন কর্মাধ্যক্ষ চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজেদের স্বার্থেই গাড়িতে জিপিএস বসাতে বাধা দিচ্ছেন তাঁরা। জেলা পরিষদের এক কর্তার ব্যাখ্যা, কর্মাধ্যক্ষরা বেশি রাস্তা দেখিয়ে মোটা অঙ্কের তেলের বিল পেশ করছেন। তেলের বিল অস্বাভাবিক হলেও হাতে-নাতে ধরতে পারা যাচ্ছিল না। জিপিএস বসালে কোথায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা সহজেই জানা যাবে। তাই, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জেলা পরিষদের সভাধিপতি শম্পা ধাড়া বলেন, তেলের খরচ কমানোর জন্য চেষ্টা চলছে। এখনই গাড়িতে জিপিএস বসছে না। জিপিএস বসালে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
     এদিকে জেলা পরিষদের নিজস্ব তহবিলের অবস্থাও বেশ খারাপ। জেলা ভাগের পর নিজস্ব তহবিলে টান পড়েছে। ২০১৪-১৫ সালে নিজস্ব ফান্ডে বিভিন্ন খাতে ৭ কোটি ৩৮ লক্ষ ৭১ হাজার ১৮৭ টাকা জমা পড়ে। খরচ হয় ৭ কোটি ১ লক্ষ ৪১ হাজার ১৬০ টাকা। ২০১৫-১৬ সালে নিজস্ব তহবিলে ৫ কোটি ১ লক্ষ ২ হাজার ৫০২ টাকা জমা পড়ে। খরচ হয় ৫ কোটি ৪৯ লক্ষ ৭৮ হাজার ৬৫৫ টাকা। ২০১৬-১৭ সালে নিজস্ব তহবিলে আয় হয় ৫ কোটি ৮৯ লক্ষ ২৪ হাজার ৯৭৫ টাকা। খরচ হয় ৪ কোটি ৫০ লক্ষ ১৬ হাজার ৯৭৯ টাকা। ২০১৭-১৮ বের্ষ ওন ফান্ডে ৫ কোটি ১১ লক্ষ ৯৮ হাজার ১০ টাকা জমা পড়ে। খরচ হয় ৭ কোটি ৮৮ লক্ষ ৫৯ হাজার ৮২৩ টাকা। অর্থাৎ ৪ বছরে নিজস্ব তহবিলে জমা পড়েছে ২৩ কোটি ৪০ লক্ষ ৯৬ হাজার ৬৭৪ টাকা। খরচ হয়েছে ২৪ কোটি ৮৯ লক্ষ ৯৬ হাজার ৬১৭ টাকা। নিজস্ব তহবিলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪৮ লক্ষ ৯৯ হাজার ৯৪৩ টাকা। লাগাম ছাড়া খরচের ফলে জেলা পরিষদের নিজস্ব তহবিলে টান পড়েছে। তাতে রাশ টানতে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা পরিষদ। বিভিন্ন জায়গায় জেলা পরিষদের হাতে থাকা জমি জবর দখল হয়ে রয়েছে। সেইসব জমি দখলমুক্ত করে সেখানে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প করে আয় বাড়ানো যেতে পারে। জেলা পরিষদের নিজস্ব জলাশয়ে মাছ চাষ করে আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে জেলা পরিষদের। এছাড়া জেলা পরিষদের নিজস্ব ছাপাখানাটিকে আধুনিক করে গড়ে তুলে তার মাধ্যমে আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে জেলা পরিষদের। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় জেলা পরিষদের বাংলোগুলিকে সুন্দর করে সাজিয়ে সেখানে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করে আয় বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা রয়েছে জেলা পরিষদের। সভাধিপতি বলেন, নিজস্ব তহবিলের আয় বাড়াতে বেশকিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

Exit mobile version