বিপুন ভট্টাচার্য, বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :-লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই গোটা রাজ্যের পাশাপাশি পূর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন ব্লকে ব্লকে বিজেপি কর্মীদের হাতে তৃণমূল সমর্থকদের আক্রান্ত হবার ঘটনা ঘটেই চলেছে। একইসঙ্গে বেদখল হয়ে চলেছে তৃণমূলের দলীয় পার্টি অফিস। রাতারাতিই তৃণমূলের পার্টি অফিস পরিণত হচ্ছে বিজেপির পার্টি অফিসে। আর এই ঘটনায় বৃহস্পতিবার তৃণমূল কংগ্রেসের জেলার পদাধিকারীদের নিয়ে দলের জেলা সভাপতি স্বপন দেবনাথ পর্যালোচনা বৈঠক ডাকলেও কর্মীদের অভিযোগের চাপে কার্যত মাঝপথেই বৈঠক বন্ধ করে চলে যান স্বপনবাবু। উল্লেখ্য, বুধবারও মাধবডিহি থানার বড়বৈনানে ভোটের পর দলীয় পর্যালোচনা বৈঠক ছেড়ে বের হবার পথে রায়না ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আনসার আলী খানকে অতর্কিতে আক্রমণ করার অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অভিযোগ উঠেছে,দুপুরের দিকে দলীয় কর্মীদের নিয়ে আনসার সাহেব যখন বৈঠক করছিলেন তখন বিজেপি এবং সিপিআই(এম)-এর কিছু সশস্ত্র সমর্থক তারাই সশস্ত্রভাবে আনসার সাহেবকে আক্রমণ করে। আচমকা এইে হামলায় তৃণমূল সমর্থক কর্মী এবং নেতারা হতচকিত হয়ে পড়েন। জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক এবং দলীয় পর্যবেক্ষক উত্তম সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, ভোটের পর জেলা জুড়ে দলীয় পর্যালোচনা বৈঠক সর্বত্রই হচ্ছে। আনসার সাহেব যখন বড়বৈনান অফিসে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন তখনই সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা আক্রমণ করে। এই ঘটনায় ১৬জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। অন্যদিকে,ভাতারের নবাব নগর ক্যাম্পে বুধবার রাতে বিজেপি তৃণমূল সংঘর্ষ হয় বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এই ঘটনায় তৃণমূলের সুশান্ত বিশ্বাস নামে এক নেতা আহত হয়ে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কার্যত প্রতিদিনই জেলার কোনো না কোনো প্রান্তে বিজেপি তৃণমূল সংঘর্ষ, পার্টি অফিস দখলের ঘটনা ঘটেই চলেছে। আর এই ঘটনায় রীতিমত উদ্বিগ্ন বিজেপি, তৃণমূল এমনকি কংগ্রেস নেতারাও। ইতিমধ্যেই বিজেপির জেলা সভাপতি সন্দীপ নন্দী জেলা প্রশাসনের কাছে এই ধরণের ঘটনায় বিজেপির দলীয় স্তরে কোনো অনুমোদন নেই বলে সাফ জানিয়ে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবার আবেদন জানিয়েছেন। জেলা কংগ্রেসের কার্য্যকরী সভাপতি কাশীনাথ গাঙ্গুলীও পৃথকভাবে এই ধরণের ঘটনা রোধে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। রাজ্যের শাসকদলও জেলা পুলিশ সুপারের কাছে এব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার আবেদন জানিয়েছে। বস্তুত, লাগাতার এই ঘটনার জেরেই তৃণমূলের কর্মী মহলেই প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দেওয়ায় এবং একইসঙ্গে দলের নেতাদের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেওয়ায় ড্যামেজ কন্ট্রোল করতেই বৃহস্পতিবার দলের পর্যালোচনা বৈঠক ডাকেন স্বপন দেবনাথ। কার্যত রাজ্যের শাসকদল গেরুয়া শিবিরের কাছে গোটা জেলা জুড়েই কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছে। এইপরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বিকালে পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের অঙ্গীকার হলে হাজিরে ছিলেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। হাজির ছিলেন বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা আসনের পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী মমতাজ সংঘমিতা এবং বর্ধমান পূর্ব আসনের জয়ী প্রার্থী সুনীল মণ্ডলও। এদিন সভায় স্বপনবাবু দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দেন, কোন কোন এলাকায় কতগুলি পার্টি অফিস দখল নেওয়া হয়েছে এবং দলীয় কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন তার তালিকা জেলায় পাঠাতে। সেই তালিকা পাবার পরই জেলা প্রশাসনের কাছে তা দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার আবেদন জানানো হবে বলে স্বপনবাবু জানান। কিন্তু এই বৈঠক চলার মাঝেই তৃণমূলের একাধিক নেতা লোকসভা নির্বাচনের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ এবং কারা কারা এই পরাজয়ের জন্য দায়ী তাদের চিহ্নিত করে দলীয় স্তরে ব্যবস্থা নেবার আবেদন জানাতে থাকেন। আর এই নিয়েই শুরু হয় তীব্র বাক বিতণ্ডা। রীতিমত হুমকি পাল্টা হুমকির জেরে স্বপনবাবু মাঝপথেই বৈঠক শেষ করে দ্রুত এলাকা ছেড়ে চলে যান। এদিন তৃণমূলের নেতারা জোড়ালো অভিযোগ তুলে জানান, বর্ধমান শহরের একাধিক নেতা পাকাপোক্তভাবে তোলাবাজির সঙ্গে যুক্ত। গোলাপবাগের কাছে একটি পার্টি অফিসকে প্রোমোটারের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ তোলেন। একাধিক নেতা এদিন দলের নেতাদের কাজকর্ম নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। লোকসভা নির্বাচনের আগে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁরা হারলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে দল। উল্লেখ্য, বর্ধমান পুরসভার ৩৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১টি ওয়ার্ডেই তৃণমূল হেরে বসে আছে। এদিন সেই প্রসঙ্গ তুলে বেশ কয়েকজন নেতা দলের উর্ধতন নেতৃত্ব এই ২১জন প্রাক্তন কাউন্সিলারের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন তা জানতে চান। এমনকি বহু ব্লকেই তৃণমূল একাধিক বুথে পরাজিত হয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রেও কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা জানতে চান। কিন্তু এই প্রসঙ্গে এড়িয়ে যেতে থাকেন স্বপনবাবুরা। আর তারপরই শুরু হয় নেতাদের বিক্ষোভ। রীতিমত একে অপরকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে থাকেন। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে থাকায় বৈঠক মাঝপথেই শেষ করে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যান তৃণমূল কংগ্রেসের পূর্ব বর্ধমান জেলা সভাপতি স্বপন দেবনাথ। অপ্রীতিকর এই অবস্থায় স্বপনবাবু কোনো কথা বলতে চাননি। বৈঠক ভেস্তে যাওয়া এবং দলের নেতাদের হৈ হট্টগোলের প্রশ্ন এড়িয়ে তিনি বলেন, এদিন পার্টি অফিস দখল এবং দলীয় কর্মীদের আক্রান্ত হবার বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক ডাকা হয়েছিল। ব্লক ভিত্তিক তালিকা দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।