গণেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- চুরি করা মোবাইলের সূত্রে জামালপুর থানার আঝাপুরে মহিলা আইনজীবীকে খুনের কিনারা করল পুলিস। সোনার গয়না, টাকার সঙ্গে মহিলা আইনজীবীর মোবাইলটিও চুরি হয়। চুরি করা মোবাইলটি তার শ্যালককে রাখতে দেয় প্রশান্ত ক্ষেত্রপাল। কালনা থানার ভবানন্দপুরে প্রশান্তর শ্বশুরবাড়ি। ঘটনার পর থেকে মোবাইলটি বন্ধ ছিল। মোবাইলটি যে চুরি করা তা শ্যালককে জানায়নি প্রশান্ত। শনিবার অ্যানড্রয়েড ফোনটি চালু করে তার শ্যালক। ঘটনার পর থেকেই মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনের উপর নজর ছিল পুলিসের। চালু হতেই মোবাইলের লোকেশন জানতে পারে পুলিস। ঘটনার পর প্রশান্তকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল পুলিস। কিন্তু, পেশাদার অপরাধীর মত পুলিসের জেরা মোকাবিলা করে সে। শনিবার রাতে তাকে ফের ডেকে পাঠানো হয় আঝাপুর ক্যাম্পে। ভবানন্দপুরে তার কেউ থাকে কিনা তা প্রশান্তর কাছে জানতে চায় পুলিস। সেখানে তার শ্বশুরবাড়ি বলে জানায় সে। এরপরই পুলিস খুনে প্রশান্তর জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়। কিছুক্ষণ জেরার পরই সে ভেঙে পড়ে খুনের কথা কবুল করে নেয়। তার সঙ্গে খুনে সুজিত ঘোড়ুইও ছিল বলে জানায় সে। ঘটনার পর সুজিত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। দুইয়ে-দুইয়ে চার হতেই সুজিতের খোঁজ শুরু করে পুলিস। সে খণ্ডঘোষ থানার বোঁয়াইচণ্ডীতে মামারবাড়িতে রয়েছে বলে পুলিস জানতে পারে। সেখান থেকে তাকে ধরা হয়। সোমবার প্রশান্ত ও সুজিতকে বর্ধমান আদালতে পেশ করা হয়। চুরির মালপত্র উদ্ধারের জন্য এবং ঘটনার পুনির্নর্মাণ করতে ধৃতদের ১৪ দিন পুলিসি হেফাজতে নিতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানান তদন্তকারী অফিসার মির মুজিবুর রহমান। আইনজীবী খুনে ধৃতদের হয়ে বার অ্যাসোসিয়েশনের কোনও আইনজীবী দাঁড়াবেন না বলে আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল। সেইমতো এদিন ধৃতদের হয়ে কোনও আইনজীবী দাঁড়ান নি। সরকারি আইনজীবী ও তদন্তকারী অফিসারের বক্তব্য শুনে ধৃতদের ১০ দিন পুলিসি হেফাজতে পাঠানোর নিের্দশ দেন ভারপ্রাপ্ত সিজেএম সোমনাথ দাস।
পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, সুজিত ডাব বিক্রেতা। বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাব সংগ্রহ করে আঝাপুর মোড়ে সে বিক্রি করত। মিতালি দেবীর বাড়ি লাগোয়া পুকুর পাড়ে বেশ কয়েকটি নারকেল গাছ রয়েছে। ডাব পাড়ার জন্য মাঝেমধ্যেই মিতালি দেবী তাকে ডাকতেন। তবে, ডাব পাড়ার জন্য ঠিকমতো পারিশ্রমিক মিলত না আইনজীবীর কাছ থেকে। এ থেকেই আইনজীবীর উপর রাগ ছিল সুজিতের। মাসখানেক আগে থেকে মিতালি দেবীর বাড়িতে ডাকাতির পরিকল্পনা করে সে। যাতায়াতের সুবাদে সন্ধ্যার পর থেকে মিতালি দেবী বেশিরভাগ সময় বাড়িতে একা থাকতেন তা জানা ছিল সুজিতের। মিতালি দেবীর সোনার গয়না ও টাকা-পয়সা ভালোই আছে বলে ধারণা ছিল তার। ডাকাতির জন্য সে প্রশান্তর সঙ্গে যোগাযোগ করে। সুজিতের ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে। প্রশান্ত রাজি হয়ে যায়। ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ পাঁচিল টপকে আইনজীবীর ঘরে ঢোকে তারা। সেই সময় ঘরে আনাজ কাটছিলেন মিতালি দেবী। শৌচালয়ে যাওয়ার জন্য তিনি ঘর থেকে বের হন। বেরিয়ে শৌচালয়ের কিছুটা দূরে মরাইয়ের পাশে সুজিত ও অপর একজনকে লুকিয়ে থাকতে দেখেন তিনি। চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করেন মিতালি দেবী। ভয় পেয়ে তাঁর মুখ দু’জনে মিলে টিপে ধরে। মিতালি দেবী বাধা দেওয়ায় সিঁড়ির পাশে থাকা ফুলের টব দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করা হয়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। দেওয়ালে তাঁর মাথা ঠুকে যায়। তিনি সংজ্ঞা হারান। এরপর তাঁর হাত-পা বেঁধে ঘরে ঢুকে সোনার গয়না, টাকা-কড়ি ও মোবাইল নিয়ে পালায় প্রশান্ত ও সুজিত। তাড়াহুড়োয় সব সোনার গয়না নিয়ে যেতে পারেনি তারা। পাঁচিল টপকেই তারা পালিয়ে যায়। তবে, মিতালি দেবী যে মারা গিয়েছেন তা তারা বুঝতে পারেনি।
জিজ্ঞাসাবাদে পুলিস আরও জেনেছে, মিতালি দেবীর বাড়িতে চুরির পর প্রশান্ত ও সুজিত স্থানীয় একটি ধাবায় যায়। সেখানে তাদের সঙ্গে প্রশান্তর শ্যালক ও আরও একজন ছিল। চুরির টাকা দিয়ে তারা চারজনে বিদেশি মদ খায়। মোবাইলটি শ্যালকের কাছে রাখতে দেয় প্রশান্ত। তবে, ঘটনার বিষয়ে শ্যালক বা অপরজনকে তারা কিছুই জানায় নি। পরেরদিন মিতালি দেবীর খুনের বিষয়টি সামনে আসার পর দিব্যি ঘটনাস্থলে আসে প্রশান্ত। এমনকি খুনের ঘটনার প্রতিবাদে পুলিসের বিরুদ্ধে আন্দোলন হওয়া উচিত বলে প্রতিবেশীদের জানায় সে। এমনিতে এলাকায় গাঁজা খোর হিসাবে পরিচিত প্রশান্ত। কয়েকদিন ধরে সে ধাবায় বিলাতি মদ খাচ্ছিল। তাই, তার উপর এমনিতেই নজর ছিল পুলিসের। মোবাইলের সূত্র মিলতেই পুরো বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় পুলিসের কাছে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিস এক জোড়া চপ্পল, গামছা, ছেঁড়া জামার অংশ ও একটি বোতাম পেয়েছে। মিতালি দেবীর ডান হাতে রক্তমাখা চুল পেয়েছে পুলিস। বাজেয়াপ্ত হওয়ার জিনিসপত্র ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞরাও ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন। অভিযোগ প্রমাণে ময়না তদন্ত, ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ফরেন্সিক রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বলে আশা পুলিসের।