কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ের উৎস সন্ধানে
ড. স্বপনকুমার ঠাকুর
দেবসেনাপতি কার্তিক। সুঠাম চেহারা। মাথার চুল বাবরি করা। সরু গোঁফ। দুধে আলতায় মেশানো গায়ের রঙ। হাতে যুদ্ধাস্ত্র তীর-ধনুক। ঋগ্বেদে কার্তিকের উল্লেখ নেই। অথর্ববেদে কুমার নামে এক আগুন দেবতার সন্ধান মেলে। বৈদিক যুগের শেষের দিকে কুমার ক্রমশ শৈবসাধনায় যুক্ত হয়েছে। এই কারণে কার্তিক শিবপুত্র। মহাভারতে দেখি কার্তিক ছয় ঋষিপত্নীকে মা বলে আপন করে নিলেন। এরা কৃত্তিকা নামে পরিচিত। সেই সূত্রে স্কন্দ বিশাখের নাম হলো কার্তিক।
গবেষকদের মতে কার্তিক লোকজ স্তর থেকে উঠে আসা দেবতা। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে স্কন্দ কার্তিককে ভয়ংকর লৌকিক দেবতা বলা হয়েছে। স্কন্দ মূলত যুদ্ধের দেবতা। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত স্কন্ন থেকে। এর অর্থ বীজ বা বীর্য। বীর্য যার আছে সেই বীর্যবান অর্থাৎ সাহসী নির্ভীক শক্তিশালী। আবার স্কন্দ শব্দের শব্দার্থ থেকে বোঝা যায় তিনি কৃষিদেবতা। একসময় চোর-ডাকাতদের দেবতাও কার্তিক। কহলনের রাজতরঙ্গিণী থেকে জানা গেছে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে পুন্ড্রবর্ধনে অর্থাৎ আধুনিক উত্তরবঙ্গে প্রায় ঘরে ঘরে কার্তিক পুজো হতো। প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি মালদহের সাহাবাড়ির কার্তিক চতুর্ভুজ বাঁকিবিহারিলালের পুজো বিখ্যাত। এই পরিবারের বিশেষ প্রথা হলো প্রথম পুত্রসন্তান হলে একটি করে দেবপ্রতিমার বাড়তি সংযোজন। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি এবং বেলডাঙা; হুগলির বাঁশবেড়িয়া, বাঁকুড়ার সোনামুখির কার্তিকপুজোও বেশ জমজমাট।
তবে কাটোয়ার কার্তিক পুজো কার্তিক লড়াই নামে দক্ষিণবঙ্গে সুপরিচিত। প্রবাদ আছে বারবিলাসিনীদের কার্তিক পুজো আর শহুরে জমিদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এই নিয়ে শুরু হয়েছিল কার্তিক লড়াই। যদিও কাটোয়ার কার্তিক পুজো সম্পর্কে কাটোয়ার খ্রিষ্টানমিশনারিদের লেখায়, নিবারণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাটোয়ার ইতিহাসে আদৌ কোন উল্লেখ নেই। কথিত আছে, বর্তমান হরিসভা পাড়ার বারবিলাসিনীদের ন্যাঙটো কার্তিকের উপাসনা থেকেই কার্তিক লড়াইয়ের সূত্রপাত। এই লোকশ্রুতিটুকু বাদ দিলে নিবিড় ক্ষেত্রানুসন্ধানে দেখা গেছে কাটোয়ার কার্তিক পুজোর উৎসের মূলে রয়েছে তার ‘থাকা’ পুজো।
কাটোয়া শহরের অন্যতম প্রাচীন জনবসতি তাঁতিপাড়া। এখানে রয়েছে ধর্মরাজের থান, বর্গি হাঙ্গামার স্মৃতিবাহী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দির-সহ সাতভাই রাজার ‘থাকা’ কার্তিক। এই প্রাচীনপুজো্টির একাধিক বৈশিষ্ট্য মানতরীতি্তে পুজোপদ্ধতিতে দেখি। প্রথম থেকেই বিশেষ প্রযুক্তিতে নির্মিত বাঁশের থাকায় এর পুজো হচ্ছে। সাধারণত একাধিক মূর্তি একটি ফ্রেমে সন্নিবেশ করতে হলে চালির সাহায্য নিতে হয়। যেমন সাত পুতুলের জন্য দুর্গার একচালিমূর্তি চালু হয়েছিল। কিন্তু পুতুলের সংখ্যা যখন ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে হয় তখন স্বল্প পরিসরে চালিতে আঁটা আর সম্ভব হয়না। এই সমস্যার জন্য বিশেষ লোকপ্রযুক্তিতে নির্মিত বাঁশ দিয়ে নির্মিত এই ‘থাকা’ যা আদতে একটা সিঁড়ির মত গ্যালারি। উচ্চতায় ১৫ থেকে ২০ ফুট কিন্তু চওড়া মাত্র ছয় থেকে সাত ফুট সমকোণী ত্রিভুজাকৃতি থাকায় একসাথে ৩১ টা পুতুল অনায়াসে ধরবে।
আনুমানিক অষ্টাদশ শতকে এই থাকার উদ্ভব। প্রথম যুগে থাকা এতবড়ো ছিল না। ধীরে ধীরে তার বিবর্তন ঘটেছে। থাকায় ক্রমশ যাত্রাশিল্পের প্রভাব পড়েছে। মহাভারত পুরাণাদির নানা নাট্য কাহিনিকে মৃৎপ্রতিমার মধ্যদিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই বিশেষ লোক প্রযুক্তিটি সারাবাংলায় একমাত্র কাটোয়া-দাঁইহাট অঞ্চলেই দেখা যায়। থাকার এই আদি রূপটি আজও টিকে আছে তাঁতিপাড়ার সাতভাই কার্তিকের সাত পুতুলের বিন্যাসে। কাটোয়ার মুহুরি বাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নির্মাণে এই আদিম থাকার প্রভাব আছে। পরবর্তীকালে কাটোয়ার জমিদার আর ব্যাবসাদাররা মিলে এই থাকাতেই কার্তিক পুজোর প্রতিযোগিতা বা লড়াই শুরু করেন বিশ শতকের গোড়ারদিকে।
এমন অধিক সংখ্যক বৈচিত্র্যপূর্ণ থাকা পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও দেখা যায় না। থাকার বিষয় রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণের কাহিনি। যেমন রামের বনবাস, সীতার বিবাহ, কৃষ্ণের জন্ম, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, বকাসুর বধ ইত্যাদি। একজন কাঠামো শিল্পী, পোষাক শিল্পী ও নির্দেশকের সহায়তায় থাকা মঞ্চস্থ হয়। সবার উপরে থাকেন দেবী জগদ্ধাত্রী অর্থাৎ কাত্যায়ণী। তাঁর কোলে থাকে শিশু কার্তিক। দু’পাশে পাঁচ থেকে ছয়টি করে নৃত্যরতা সখী। মাঝে সংশ্লিষ্ট কাহিনির চরিত্রাবলী। থাকা বর্তমানে কমে এসেছে। ক্রমশ থাকাকে হটিয়ে থিমকে নিয়ে জমে উঠেছে কার্তিক লড়াই।