বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- রাজ্য জুড়ে একাধিক দুর্নীতি নিয়ে যখন রাজ্যের শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা ক্রমশই জড়িয়ে যাচ্ছেন সেই সময় এবার খোদ বর্ধমান শহরে প্রায় ৩০০ বিঘার এক বিল বুজিয়ে সেখানে প্রোমোটিং করার পিছনে নাম জড়ালো তৃণমূলের মন্ত্রী থেকে নেতাদের। এমনকি এই বিল বুজিয়ে তা ভরাট করার জন্য খোদ বর্ধমান পৌরসভার চেয়ারম্যানের সই জাল করার অভিযোগ উঠেছে। আর এই ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হতেই শহর জুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র চাঞ্চল্য। অভিযোগ উঠেছে শুধু বর্ধমান শহরের এই শশাঙ্ক বিল-ই নয়, গোটা শহর এবং শহর লাগোয়া পঞ্চায়েত এলাকাতেও লাগাতার জলাশয় বুজিয়ে বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট তোলা হচ্ছে। আর এসবের পিছনে শাসকদলের বাঘা বাঘা নেতাদের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, বর্ধমানের ইছলাবাদ মৌজায় ৩০০ বিঘা জলাভূমি ‘শশাঙ্ক বিল’-এর জমির চরিত্র বদল করা হয়েছে বলে ২০১৪ সালে পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান ডাঃ স্বরূপ দত্ত বর্ধমান থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁর সই জাল করেই বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে পৌরসভার চেয়ারম্যানের সই করা জাল নো- অবজেকশন চিঠি দাখিল করা হয়। বর্ধমান থানায় অভিযোগও হয়েছিল। তার কেস নম্বর ৬৩২/৮-৩-২০১৪। শুধু বর্ধমান থানা নয়, বিএলএল অ্যান্ড আরও-সহ একাধিক সরকারি দপ্তরে চেয়ারম্যান লিখিত চিঠি দিয়ে সই ও চিঠির মেমো নম্বর জাল করার জন্য জমির মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু, চেয়ারম্যান চিঠি দিয়ে থানা, বিএলএল অ্যান্ড আরও দপ্তরে জানালেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি কোনও অদৃশ্য কারণে তদন্তও হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, ডাঃ স্বরূপ দত্তর মৃত্যুর পরই জমি মাফিয়ারা জমির চরিত্র বদলের জন্য উঠেপড়ে লাগে। শাসকদলের নেতা, মন্ত্রীদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই রাতারাতি জলাশয় পরিণত হয়ে যায় শালি জমিতে। অথচ, ১৯৯৪ সালে বামপন্থী বোর্ড থাকাকালীন পুরসভা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করে, বর্ধমান পৌরসভার অন্তর্গত শাঁখারিপুকুর মৌজার জেএল নম্বর ৩৮, দাগ নম্বর ৪৮৪, ৪৮৫, ৪৮৮, ৪৮৩, ৪৮৬, অংশ, ৯৫ অংশ, ৯৫১ অংশ, ইছলাবাদ মৌজার জেএল নম্বর ৭৫, ৬৭, ৭১ অংশ, ২০৭১ অংশ, ১৮৪, ১১১, ১৯০, ৪০৭, ৪৫১ যে জলাশয়, পুকুর রয়েছে তা ভরাট করার জন্য ওই জমির মালিকরা চেষ্টা চালাচ্ছে। এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয় যে, ওই পুকুর, জলাশয়, ডোবা ভরাট করা হলে তা সম্পূর্ণ বেআইনি হবে ও মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তৎকালীন চেয়ারম্যান সুরেন মণ্ডলের এই বিজ্ঞপ্তিতে জমির মালিকরা জলাশয় ভরাট করা থেকে বিরত হয়। ১৯৯৪ সালেও এই জলাভূমির চরিত্র বদলের চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা পারেনি। বামপন্থিরা বার বার এই জলাশয় বোজানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। কিন্তু, ২০১৪ সাল থেকেই তৃণমূল সরকার বর্ধমান পৌরসভার ক্ষমতা পাওয়ার পর জমির মালিকরা এই জলাশয় ভরাটের চেষ্টা শুরু করে। জানা গেছে, এই জলাশয়কে শালি করা এবং প্রায় ৩০০ বিঘে এই জায়গার ওপর প্রোমোটিং করার ক্ষেত্রে রাজ্যের এক মন্ত্রীর নাম উঠে আসতে শুরু করেছে। একইসঙ্গে কয়েকজন বাঘা তৃণমূল নেতার নামও উঠে আসতে শুরু করেছে। যদিও এব্যাপারে বর্ধমান পৌরসভার চেয়ারম্যান তথা এই শশাঙ্ক বিল যে ওয়ার্ডে অবস্থিত সেই ১০নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার পরেশচন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, এখন কী আছে সেখানে? আপনারা দেখেছেন? সেখানে কি ওই পুকুর, বিল, জলা কিছু আছে? জঙ্গল আছে। একদম জঙ্গলাকীর্ণ পুরো একটা জায়গা যেখানে মশা-মাছি থেকে আরম্ভ করে সবরকমের উপদ্রব আছে। স্বাভাবিকভাবেই ওটা কবে কী ছিল, পুকুর ছিল, ডোবা ছিল, জলা ছিল -সেটা আলাদা ইতিহাস, আলাদা রেকর্ড। এবং সেই রেকর্ডগুলো দেখে, কাজ করে ভূমি রাজস্ব দপ্তর। এটা আমাদের কাজ নয়। বর্ধমান পৌরসভা আমরা অ্যাসেসমেন্ট করে শুধুমাত্র হোল্ডিং দিতে পারি, কিন্তু জমির চরিত্র বদল আমরা করতে পারি না। এখন ওই জায়গাটা যেহেতু জলা বলা হচ্ছে, পূর্বে নিশ্চয়ই হয়ত জলা ভূমি ছিল। কিন্তু এখনতো জঙ্গলভূমি। সেই অবস্থায় কে নিয়েছে কোথায় নিয়েছে তারা কীভাবে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে এবং হাইকোর্টের অর্ডার ডিএলআরও-র উপরে। ডিএলআরও-র মারফত শালি থেকে হাউসিং কমপ্লেক্স করে তারা জমির চরিত্র পরিবর্তন করে এনেছে। সব কিছু কাগজপত্র আমরা চেক করে নিয়েছি। আমাদের কাছে হোল্ডিং চেয়েছিল। আমাদের কাছে আর কিছুই চায়নি। আমি আইন যতদূর জানি হোল্ডিং চাইতেই পারেন। মালিকানা সঠিক থাকলে যেকোনও চরিত্রের জমির হোল্ডিং চাইতেই পারেন। আমাদের কাছে চেয়েছিলেন, আমরা হোল্ডিং দেবো। হোল্ডিং বেরিয়েছে। ভূমি দপ্তর বলতে পারবে কীভাবে এটা কনভারশন হয়েছে, কারা করল, কার নির্দেশে হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, পৌরসভার আগের বোর্ড এনওসি দিয়েছে। পরেশচন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, সই জাল প্রসঙ্গে তিনি কিছু জানেন না। তখন কী হয়েছে তিনি বলতে পারবেন না। এখন সমস্ত কাগজ দেখেই হোল্ডিং দেওয়া হয়েছে বলে জানান পরেশচন্দ্র সরকার।