গণেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বর্ধমান (পূর্ব বর্ধমান) :- ১৩ বছর আগে বৈদ্যনাথ কাটরায় সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বর্ধমান শাখা থেকে ৩৪ লক্ষাধিক টাকা লুট করে নিয়ে পালায় একটি ডাকাত দল। সেই ঘটনার কিনারা এখনও হয়নি। ঘটনার তদন্তে দুঁদে অফিসারদের নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছিল। ডাকাতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিস। যদিও ডাকাতির মামলায় আদালতে চার্জশিট পেশ করতে পারেনি পুলিস। ঘটনার কিনারা না হওয়ার কথা জানিয়ে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করেছে পুলিস। অর্থাৎ ব্যাংক ডাকাতির কিনারা হয়নি। মামলাটির অবশ্য এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। আইন অনুযায়ী, পুলিসের রিপোর্ট সম্পর্কে অভিযোগকারীর বক্তব্য শোনা হয়। বক্তব্য জানানোর জন্য অভিযোগকারী ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজারকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু, তিনি আদালতে হাজির হয়ে পুলিসি তদন্তের বিষয়ে মতামত জানান নি। সে কারণে কিনারা না হওয়া একটি ঘটনার মামলার দিন পড়েই চলেছে।
পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকালে বৈদ্যনাথ কাটরায় সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সকাল ৮টা ১০ নাগাদ ব্যাংকের ভিতর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে ৮ দুষ্কৃতি। ব্যাংকের গেটে কোনও নিরাপত্তারক্ষী ছিল না। হিন্দিভাষী ডাকাতরা হেড ক্যাশিয়ারের কাছে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে তাঁকে ভল্ট ও সেফের চাবি খুলতে বলে। ব্যাংকের ভল্টে ৩৬ লক্ষ ৪২ হাজার ১৯২ টাকা ৬৮ পয়সা ছিল। ডাকাতরা ৩৪ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা তিনটি চটের বস্তায় ভরে নেয়। বাকি ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ১৯২ টাকা ৬৮ পয়সা তারা নিতে পারেনি। ব্যাংকের কর্মীদের একটি ঘরে আটকে রাখে দুষ্কৃতিরা। কর্মীদের মোবাইল ফোনগুলি তারা কেড়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে অপারেশন সেরে ডাকাতরা চম্পট দেয়। যাওয়ার সময় ডাকাতরা বলে যায়, ‘সরকারি পয়সা জানে দো, তুমহারা কিয়া হ্যায়। লেকিন চিল্লাওগে তো গোলি মার দেঙ্গে।’ ঘটনার খবর পেয়ে কলকাতা থেকে ছুটে আসেন এডিজি সিআইডি ভুপিন্দর সিং, ডিআইজি সিআইডি (অপারেশন) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত, সিআইডির স্পেশাল সুপার অনিল কুমার, ডিআইজি বর্ধমান রেঞ্জ হরমনপ্রীত সিং সহ জেলা পুলিসের কর্তারা।
ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজার নিশীথেন্দু বিকাশ লোধ ঘটনার কথা জানিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। জেলার পুলিস সুপার রাজারাম রাজশেখরনের নিের্দশে জেলার দুঁদে অফিসার শঙ্খ বিশ্বাস, দেবজ্যোতি সাহা, সন্দীপ সরখেল, বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, বকতিয়ার হোসেনকে নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়। দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডিএসপি সপ্তর্ষি দত্ত। ডাকাত দলটিকে ধরতে সিআইডির সাহায্য নেওয়া হয়। ফরেন্সিক ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞরা ব্যাংকে এসে তদন্ত করেন। দলটিকে শনাক্ত করতে সিআইডির শিল্পীকে দিয়ে ডাকাতদের ছবি আঁকানো হয়। তদন্তে নেমে পুলিস বিহার, ওড়িশা ও এ রাজ্যে ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িতদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। বিহারের শৈলেন্দ্র সিং ওরফে মাহাতো, শৈলেন্দ্র, সুনীল কুমার, প্রেম সাহানি, মিঠু মিঞা, গ্যাং অব ডক্টর-এর দলের কার্যকলাপের বিষয়ে বিশদে তথ্য সংগ্রহ করে। কিন্তু, কোন দলটি সেন্ট্রাল ব্যাংকে ডাকাতিতে জড়িত সে বিষয়ে কোনও তথ্যই পায়নি। দুর্গাপুর ও বারাসতে ব্যাংক ডাকাতিতে ধৃত মহম্মদ রাজা আমেদ ওরফে রহিম আমেদ, ধরম নারায়ণ প্রসাদ ওরফে ধরমবীর কুমার, সুবোধ কান্ত ওরফে সুবোধ সিং, জয়প্রকাশ কুমার, কিষাণ পাশোয়ান ও মোসা খান ওরফে নাসিমকে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে হেফাজতে নেয় পুলিস। হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তেমন কোনও তথ্যই জোগাড় করতে পারেনি পুলিস। ঘটনার কিনারা না হওয়ার কথা জানিয়ে ২০১১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তদন্তকারী অফিসার স্নেহময় চক্রবর্তী ধৃতদের জড়িত না থাকার কথা জানিয়ে আদালতে রিপোর্ট পেশ করেন। শুক্রবার পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকেও একই কায়দায় ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতিতে ভিন রাজ্যের গ্যাং জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে পুলিসের অনুমান। এর পাশাপাশি ২০২০ সালের ১৭ জুলাই বৈদ্যনাথ কাটরা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে বর্ধমান শহরের বিসি রোডে স্বর্ণবন্ধকী সংস্থায় প্রায় একই কায়দায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সংস্থার কর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীদের আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে একটি ঘরে বন্ধ রেখে সেখান থেকে ৩০ কেজি ২০৫ গ্রাম ২০ মিলিগ্রাম সোনা নিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতিরা। লুট করা সোনার মূল্য প্রায় ১৪ কোটি ৫৬ লক্ষাধিক টাকা। পালানোর সময় বাধা পেয়ে দুষ্কৃতিরা একজনকে গুলি করে। তদন্তে নেমে সিআইডি বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে আসে। ধৃতরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্বর্ণ বন্ধকী সংস্থায় ডাকাতিতে জড়িত। ঘটনায় ইতিমধ্যেই চার্জশিট পেশ করেছে সিআইডি।