দাঁইহাটের রাস উৎসবের উৎস সন্ধানে
– ড. স্বপনকুমার ঠাকুর
দাঁইহাটের রাসের মূলকেন্দ্র বিন্দু বর্মনদের শবশিবাকে নিয়ে। বর্মনরা মূলত কোচবিহারের ক্ষত্রিয় রাজবংশী সম্প্রদায়। শ্রীচৈতন্যদেবের আমল থেকে এরা নবদ্বীপে ভিড় করেছিল জীবন জীবিকার প্রয়োজনে। শিবশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায় রচিত “শবশিব মাতার ইতিকথা” থেকে জানা যায়–নবদ্বীপের রাজবংশীদের এক গোষ্ঠী দাঁইহাটে চলে আসে এবং পিতল কাঁসার কাজে যুক্ত হয়। নবদ্বীপে ব্যাদরাপাড়ায় রাজবংশীরা পুজো করতেন পটে আঁকা শবশিবা মাতাকে। এই বংশের তান্ত্রিকসাধক ভগীরথ সিংহ স্ত্রী-পুত্র নিয়ে একসময় চলে আসেন দাঁইহাটে। শ্মশানকালীর আরাধনায় মগ্ন হন। পরে তিনি ঐ শ্মশানকালীর স্থলে প্রতিষ্ঠা করেন শবশিবা মাতাকে।
শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে দাঁইহাটে ভগীরথ সিংহ ১১০৫ বঙ্গাব্দে রাসপূর্ণিমার দিনে পটে এঁকে পুজো শুরু করেন। কিন্তু এই তথ্য সঠিক নয় বলেই মনে করি। কারণ নবদ্বীপে রাস উৎসব শুরু হয়েছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আনুমানিক ১৭৪০-৬০-র মধ্যে। দাঁইহাটে রাস উৎসবের সূচনা সেই সময়ে বা তার পরে। তবে একথা ঠিক পটে আঁকার পূর্বে শবশিবা শ্মশানক্ষেত্রে পূজিত হতেন যন্ত্রের মাধ্যমে। ৩০”X ২০”X ৯” আয়তন বিশিষ্ট বিচিত্র প্রস্তরযন্ত্রটি আজও নিত্যপূজিত হয় দেবীমন্দিরে ।
ভগীরথ পুত্র গোরাচাঁদের আমল থেকে মৃৎমূর্তিতে পূজিত হতে থাকে। অন্যতম সেবাইত নন্দগোপাল মণ্ডল জানিয়েছেন, রাজবংশীরা তথাকথিত অন্ত্যজ জাতি হওয়ার কারণে সেইসময় শিল্পী বা ব্রাহ্মণ কেউ প্রতিমা তৈরি করতে বা পুজো করতে রাজি হয়নি। পরে মাটিয়ারি থেকে ব্রাহ্মণ এসে পুজো করতেন। গোরাচাঁদের পৌত্র কেষ্টপদ সিংহর আমলে একবার দেবী মূর্তি পালবাড়ি থেকে আনতে গিয়ে ভেঙে যাওয়ায় সেবার মাঘীপূর্ণিমায় পুজো হয়ে ছিল। পরের বছর থেকে যথারীতি রাসপূর্ণিমায় পুজো হচ্ছে।
শবশিবা এক বিচিত্র তান্ত্রিক মূর্তি। লোকমতে নিচে মরা শিব উপরে জ্যান্ত শিব। এটি কালীর বিপরীত রতি বা সঙ্গমের রূপ। কালিকাপুরাণ অনুসারে প্রেতবৎ শিবের সঙ্গে কালী রমণ করেছিলেন। কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত প্রতিমাশিল্পে হিন্দু দেবদেবী গ্রন্থে লিখেছেন– “কালীতন্ত্র ও স্বতন্ত্রতন্ত্র (তন্ত্রসারে ধৃত) অনুসারে শিব শবের মতো পড়েছিলেন। কালী তাঁর সঙ্গে বিপরীত রতি করেছিলেন।” পৃ–১৫৫ এই রতিক্রীড়া মূলত সৃষ্টি ক্রিয়ার জন্য। নবদ্বীপে দুটি শবশিবা মূর্তি আসে। তবে দাঁইহাটের সঙ্গে তার পার্থক্য আছে। এখানকার মাতৃমূর্তি কালো রঙের নয়; নীলাভ আকাশি রঙের। পূর্ব বর্ধমান জেলায় মন্তেশ্বরের খ্যাদরাগ্রামে জৈষ্ঠ্যমাসে চার দিন ধরে শবশিবার পুজো হয়। কাটোয়ার কোষিগ্রামে আনন্দময়ী নামে শবশিবার পুজো হয় ধর্মরাজের গাজনের সময় বা মাঘ মাসে। বীরভূমের ঘুড়িষার লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে বা হুগলি জেলার সুখারিয়া গ্রামের আনন্দভৈরবী মন্দিরে টেরাকোটা ফলকে শবশিবা মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। গবেষকরা মনে করেন শবশিবা-ই আদি কালীমূর্তি।
দাঁইহাটে শবশিবার কাঠামো পুজো হয় ভাতৃদ্বিতীয়ার দিনে। প্রতি পূর্ণিমায় দেবীর বিশেষ পুজো হলেও রাসপূর্ণিমায় বাৎসরিক পুজো। দাঁইহাট-সহ মাটিয়ারি এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের অসংখ্য নরনারী দেবীকে “জাগ্রত” জ্ঞানে পুজো আর মানত করেন। সন্তান কামনায় মায়েরা পিতলের গোপাল মানসিক করেন। বিয়ে-থা, আনন্দ উৎসবে তথা প্রাত্যহিক জীবনে মা শবশিবা প্রকৃতপক্ষে দাঁইহাট-জননী হয়ে উঠেছেন।
দাঁইহাট বিখ্যাত ছিল কাঁসা-পিতলের শিল্প তসরের কাজ আর পাথরের ভাস্কর্যে। পাথরের কালী, কৃষ্ণ, শিব মূর্তি নির্মাণে এখানকার ভাস্করদের জুড়ি মেলা ভার। নবীন ভাস্কর তাঁর শিল্পনৈপুন্যের জন্য কলির বিশ্বকর্মা উপাধি পেয়েছিলেন। ভাস্করদের পূজিত দেবী রাসের বড়কালী। পরে এটি সার্বজনীন পূজায় পরিণত হয়। গণেষজননী মাতঙ্গিনী বহু পুরাতন পুজো। দাঁইহাটের বর্তমান বাজারপাড়া আসলে কাঁসারি পাড়া। এরা কাঁসা পিতলের শিল্পী ছিলেন। দাঁইহাটের বগি থালা ছিল বিখ্যাত। কাঁসারিদের খ্যাতি ছিল তুঙ্গে। অনিলকুমার দাস জানিয়েছেন, তাঁদের আদি নিবাস বীরভূমের কঙ্কালীতলা। প্লেগের মহামারির জন্য অনেকেই চলে আসেন দাঁইহাটে। কুলদেবতা গোপাল নারায়ণ। বর্তমানে ৩০-৩৫ ঘর কাঁসারি রয়েছেন। কাঁসা পিতলের শিল্পকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে কবে। আজ থেকে প্রায় শতাধিক বছর আগে উগ্রাচণ্ডা মূর্তির পূজা নিয়ে আসেন। প্রথমে পটে পরে মৃৎমূর্তিতে আসে।
নবদ্বীপের ভদ্রকালীর সঙ্গে দাঁইহাটের মূর্তির মিল থাকলেও অমিলও কম নেই। হনুমানের কাঁধে রাম লক্ষণ ও মাথায় মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গামূর্তি হলেও নবদ্বীপের মতো লক্ষ্মী সরস্বতী নেই। পরিবর্তে জয়া বিজয়া ও রাক্ষসী-খোক্ষসী রয়েছে। আগে আড়াই মন চালের নৈবেদ্য থাকতো। তিনপন কলা আর হনুমানের জন্য স্পেশাল দুটো ১৫ কেজি চালের বাটা-নৈবেদ্য ছিল দেখার মতো। কালের নিয়মে খানিকটা ভাটা পড়লেও আজও রাসের অন্যতম আকর্ষণ এই উগ্রচণ্ডা বা ভদ্রকালীর পুজো। রাসপূর্ণিমায় দেবীর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পুজো আর পরের দিন দশমী।
(লেখক ড. স্বপনকুমার ঠাকুর আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষক)