বিপুন ভট্টাচার্য, মেমারী (পূর্ব বর্ধমান) :- ১৯৯৩ সালের ৩১ মে পূর্ব বর্ধমানের মেমারী থানার করন্দা গ্রামে ৬জন ক্ষেতমজুরকে নৃশংস্যভাবে খুন করার মামলায় হাইকোর্টকে পুনরায় বিবেচনা করার নির্দেশ দিল সুপ্রীম কোর্ট। আর এই রায়ের পর প্রায় ২৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই নারকীয় ঘটনায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবীতে নতুন করে সোচ্চার হলেন করন্দার নিহত ও আহতদের পরিবারের লোকজনরা। ঘটনার ২৫ বছর পর সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে হাইকোর্টকে এই মামলাকে পুনরায় বিবেচনা করার এই নির্দেশের খবর এসে পৌঁছাতেই ফের আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ পরিবাররা। উল্টোদিকে খুনে সিপিআই(এম)-এর সেই অভিযুক্তরা নতুন করে আশংকায় দিন গুনতে শুরু করে দিয়েছেন। যদিও এব্যাপারে সিপিএমের পূর্ব বর্ধমান জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক জানিয়েছেন, সুপ্রীম কোর্ট মামলা ফের হাইকোর্টে পাঠিয়েছে। তাই আবার তাঁরা আইনী লড়াই করবেন। এই ঘটনায় রাজ্য রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেই জানিয়েছেন অচিন্ত্যবাবু।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যেই রাজ্য জুড়ে সিপিএম লাগাতার আন্দোলন সংগঘটিত করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ১৯৯৩ সালে সিপিএম যে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনেই কী ধরণের ভয়ংকর সন্ত্রাস সৃষ্টি করে নৃশংস্যতার বর্বর রূপ তুলে ধরেছিল করন্দায় – নতুন করে তা আবার সামনে চলে আসায় শোরগোল পড়েছে।
কি ঘটেছিল সেদিন? ১৯৯৩ সালের ৩১ মে সকাল ৯টা। তার আগের দিন রাজ্য জুড়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ওই সময়েই সিপিএমের স্বজনপোষণ, দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন করন্দা, খাঁড়গ্রামের সিপিএমের একাংশ। বিশেষ করে খোদ করন্দা গ্রামের সমবায়ের দুর্নীতি নিয়ে দলেরই একাংশ রীতিমত সরব হওয়ায় এবং সিপিএমের সেইসময়কার জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকে এব্যাপারে বারবার জানালেও কোনো ফল না পাওয়ায় দলের এই বিক্ষুব্ধরা সিপিআইএমএলের সঙ্গে যুক্ত হয়। গোটা বিষয়টিকে ভালভাবে নিতে পারেনি সিপিএম নেতৃত্ব। শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই পরিকল্পনা রচনা। শহীদ পরিবারের সদস্যরা দাবী করেছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে এই গ্রামেই সভা করেছিলেন সিপিএম নেতা তথা তত্কালীন মন্ত্রী (বর্তমানে প্রয়াত) করন্দার বাসিন্দা রামনারায়ণ গোস্বামী। শহীদ পরিবারের দাবী, প্রকাশ্য সভায় তিনি বলেছিলেন, এবার আর দশহরায় ছাগবলি হবে না, হবে মানুষবলি। আর তারপর রীতিমত পরিকল্পনামাফিক ৩১ মে সাতসকালেই গ্রামে রটিয়ে দেওয়া হয় স্থানীয় সিপিএম নেতা ভানু হাতিকে গলা কেটে খুন করে আইপিএফের সদস্যরা। আর তারপরেই সকাল ৯টায় একেবারে পৈশাচিক রক্তের হোলি খেলে সিপিএমের সমর্থকরা।
উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালের ওই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ইণ্ডিয়ান পিপলস্ ফ্রণ্টের ব্যানারে (যদিও নির্দল হিসাবেই) তারা প্রার্থী দেন। সিপিআই (এম এল) লিবারেশন-এর কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা কার্তিক পাল জানিয়েছেন, পূর্ব বর্ধমান জেলায় তাঁরা প্রায় ১০০-রও বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছিলেন। করন্দা গ্রামের ৩টি আসনে তাঁরা কার্যত জয়লাভও করেছিলেন। কিন্তু সিপিএমের তত্কালীন নেতৃত্ব মারধর করে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে দখল নেয় নবস্থা ২নং গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরের দিন সকালে আইপিএফের সদস্যরা বাদল মালিকের বাড়িতে বসে মিটিং করছিলেন। সেই সময় গোটা পূর্ব পাড়াকে ঘিরে ফেলে সশস্ত্র সিপিএমের বাহিনী। একের পর এক বাড়িতে লাগিয়ে দেওয়া হল আগুন। বাদল মালিকের বাড়িতেও লাগিয়ে দেওয়া হয় আগুন। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে বের হতেই দিলীপ পাকড়ে, সোম কোঁড়া, হীরু মালিক, সাধন নায়েককে একের পর এক কুপিয়ে পিটিয়ে খুন করে পা ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে মৃতদেহগুলিকে জড়ো করা হয় পূর্ব পাড়ার রাস্তার ওপর। হাতের কাছে যাদের সেদিন পেয়েছে সিপিএমের সশস্ত্র বাহিনী তাদেরই মারা হয়েছে। বাদ যায়নি মহিলা থেকে শিশুরাও। টাঙির কোপ বাঁচিয়ে বাদল মালিকের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ছুটে পালাতে চেয়ে পুকুরে ঝাঁপ মেরেছিলেন মানিক হাজরা। পুকুরের একপাড় থেকে সাঁতরে ওপারে উঠতেই তাঁর অণ্ডকোষ কেটে নিয়ে মলদ্বার দিয়ে লোহার রড ঢুকিয়ে নৃশংস্যভাবে খুন করা হয়। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা টানা ৪ ঘণ্টা ধরে পৈশাচিক উল্লাস চালানোর পর ঘটনাস্থলেই ৫জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান রতন মল। প্রায় ২৪ জন গুরুতর জখম হন। আজও সেই আঘাত বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই।
সিপিআই (এম এল) লিবারেশন-এর বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য শ্রীকান্ত রানা জানিয়েছেন, এই ঘটনায় বাদল মালিকের বৌদি মেনকা মালিক মেমারী থানায় অভিযোগ করেন। মামলা করা হয় বর্ধমান আদালতে। কিন্তু সুবিচার মেলেনি। মামলা করা হয় হাইকোর্টে। কিন্তু সেখানেও মেলেনি সুবিচার। এরপরই ২০০৯ সালে তাঁরা সুপ্রীম কোর্টে মামলা করেন। গত মঙ্গলবার সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদ্বয় এন ভি রামানা এবং মোহন এম সান্তনাগৌড়ার বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়কে খারিজ করে দিয়ে পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর তাতেই আশার আলো দেখছেন নিহত ও আহতদের পরিবার। তাঁরা চাইছেন উপযুক্ত শাস্তি হোক দোষীদের। উল্লেখ্য, এই ঘটনায় মোট ৮৪জনের নামে অভিযোগ দায়ের হলেও পুলিশ শেষ পর্যন্ত ১৭জনের নামে ফাইনাল চার্জসিট পেশ করে। ইতিমধ্যেই অভিযুক্তদের অনেকেই মারাও গেছেন। কিন্তু চলতি সময়ে সিপিএম যখন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ এনে বাজারগরম করার চেষ্ট করছে, সেই সময় ২৫ বছর আগের সিপিএমের মুখোশ ফের খুলে পড়ায় অস্বস্তিতে পড়েছে সিপিএম নেতৃত্ব। গোটা গ্রামের মানুষ এখন তাকিয়ে হাইকোর্টের দিকে। যদিও গ্রামসূত্রেই জানা গেছে, সেই সময়কার অভিযুক্ত সিপিএমের অনেকেই এখন তৃণমূল কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিণতি কি দাঁড়ায় সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন করন্দার গ্রামে।