আসানসোল ও বর্ধমান, ১০ জানুয়ারিঃ- আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে পাখির চোখ করে রাজ্যের শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত বর্ধমানে এসে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি নীতির তীব্র সমালোচনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি তাঁদের উন্নয়নে রাজ্য সরকারের নানা পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে কৃষকদের মন জয়ের চেষ্টা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের নানা উন্ন্যনমূলক কাজের পরিসংখ্যান তুলে ধরে পঞ্চায়েত এবং জেলা পরিষদে তৃনমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আনার জন্য আহ্বান জানালেন মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার প্রথমে আসানসোল পোলো গ্রাঊন্ডে এবং পরে বর্ধমান পুলিশ লাইনে সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিন তিনি আসানসোল এবং বর্ধমান থেকে দুর্গাপুর সিটি সেন্টারে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উৎপাদিত জিনিস পত্র প্রদর্শন ও বিপনন কেন্দ্র ‘সবলা’, পানীয় জল প্রকল্প, কেতুগ্রাম-১ ব্লকের খালিপুর হাই মাদ্রাসা এবং কেতুগ্রাম এস এ এম ইন্সটিটিউশনে সংখ্যালঘু ছাত্রী নিবাসের উদ্বোধন করেন। ৩১.৫৫ একর জমির উপর কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, দুর্গাপুরে ৭৮২.৫৬ টাকা ব্যয়ে ২৭.৯৪ একর জমিতে দুর্গাপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট, পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প, দুর্গাপুরে ৫ একর জমিতে প্রায় ১০ কোটি ৪৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ইন্সটিটিউট অফ হোটেল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ক্যাটারিং টেকনোলজি, মেমারিতে পলিটেকনিক কলেজ, গলসি-২ ব্লকে ৫০০০ মেট্রিক টন ক্ষমতা সম্পন্ন পাঁচটি খাদ্য সংরক্ষণ কেন্দ্র, ভাতারে স্নাতক স্তরের কলেজ, মঙ্গলকোটে এবং ভাতারে ২ টি আই টি আই, বর্ধমানে সমবায় ভবন, পারুলিয়ায় শাক-সবজি এবং ফুলের বিপণন কেন্দ্রের শিলান্যাস করেন মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়াও নিজগৃহ-নিজভূমি প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীনদের পাট্টা, সাইকেল, প্রতিবন্ধীদের সহায়ক যন্ত্র এবং আর্থিক সাহায্য, শাক-সবজির ক্রেটগাড়ি, আর্টিজান ক্রেডিট কার্ড এবং পরিচয় পত্র, কৃষি খমারের জন্য সরঞ্জাম, মহিলা সমৃদ্ধির চেক, কৃষকদের পাম্পসেট বিদ্যুতি করনের জন্য এক কালীন আর্থিক অনুদান তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
বাম আমলে আসামী ছিনতাই, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া এবং পুলিশের উপর আক্রমণ -এর ঘটনায় রায়না থানা এলাকার জোৎসাদি গ্রামে পুলিশের গুলিতে নিহত তৃনমূল কর্মী হাসমত মল্লিক এবং কাজল মোল্লা -র স্ত্রী যথাক্রমে জীবন্নেসা মল্লিক ও জীন্নাতারা মোল্লাকে হোম গার্ডে চাকরীর নিয়োগপত্র তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিপিএম এবং কংগ্রেসকে এক আসনে বসিয়ে বেঁধেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, আমাদের হাতে একটা পয়সা নেই। কেন্দ্রীয় সরকার সব টাকা কেটে নিচ্ছে। তা সত্ত্ব্বেও রাজ্য সরকার উন্নয়ন চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার বেশির ভাগই করে ফেলা হয়েছে। কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলিও দ্রুত করে ফেলা হবে। কৃষি বলয় বর্ধমানে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বৈতরনি পার হতে কৃষকদের ভোট সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। বাম আমলে রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এই জেলায়। তৃনমূল সরকার গঠিত হওয়ার পরও চিত্রটা বিশেষ বদলায়নি। বর্তমান সরকারের আমলেও মহাজনী ঋণের খপ্পরে পড়ে এবং চাষে লোকসান হওয়ায় বেশ কয়েকজন চাষি আত্মঘাতী হন। চাষি আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনাকে সামনে রেখে হারিয়ে যাওয়া জমি ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সিপিএম। সম্ভবত সেকথাকে মাথায় রেখেই এদিন কৃষকদরদী বক্তব্য রাখেন মমতা। কেন্দ্রের সরকারকে আক্রমণ করে তিনি বলেন, দিল্লির সরকার সারে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১০ সাল থেকে কেন্দ্রিয় সরকার সারের দাম বাড়িয়ে চলেছে। ফলে, চাষিরা সমস্যায় পড়েছেন। শুধু সারই নয়, ডিজেল, পেট্রোল, গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। রেলের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। মানুষকে সমস্যায় ফেলে বড়বড় কথা বলছে। কিন্তু, চাষিরা যাতে সমস্যায় না পড়েন, তাঁদের মাথায় যাতে হাত না পড়ে সেজন্য রাজ্য সরকার সব ধরনের চেষ্টা চালাবে রাজ্য সরকার। চাষিদের কৃষাণ ক্রডিট কার্ড বিলি করা হয়েছে। চাষিরা যাতে সহজে ব্যাঙ্ক ঋণ পান সেজন্য চেষ্টা করা হবে। পাম্পসেট বিদ্যুতি করনের জন্য এক কালীন সাহায্য দেওয়া হয়েছে। ধানের সহায়ক মূল্য বাড়িয়ে ১২৫০ টাকা করা হয়েছে। সার নিয়ে সমস্যা কাটাতে এরাজ্যে সার কারখানা তৈরি করা হবে। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভর করতে হবেনা।
সরকারের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পুলিশে ৪০-৪৫ হাজার নিয়োগ হয়েছে। ১ লক্ষ শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। ভিলেজ পুলিশেও নিয়োগ হয়েছে। ৫ টি কমিশনারেট তৈরি করা হয়েছে। ১৯ টি মানবাধিকার কোর্ট করা হয়েছে। ৪৫ টি মহিলা আদালত তৈরি হবে যা ভারতে প্রথম। ১৫১ টি ফাস্টট্রাক কোর্ট যে গুলি কেন্দ্রিয় সরকার তুলে দিতে চাইছিল তা রাজ্য সরকার রেখে দিচ্ছে যাতে বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠ এবং তাড়াতাড়ি হয়। সিপিএম পাট্টা দিত আর ভোটের পর গাট্টা দিয়ে কেড়ে নিত। কিন্তু আমাদের সরকার নিয়ম মেনে পাট্টা দেবে। আগামী ৩ বছরে এমন কোনও গরীব মানুষ থাকবেনা যার মাথায় ছাদ থাকবেনা। গৃহহীনদের ৩ কাঠা জমির পাশাপাশি বাড়ি তৈরির ব্যবস্থা করে দেবে সরকার। ১০০ দিনের কাজে জেলার সাফল্য তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এখানে ৪০ দিন কাজ পেয়েছেন জব কার্ড হোল্ডাররা। দেশের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে বর্ধমান। সিপিএমের আমলে ১৮ দিনের বেশি কাজ পেতেন না গরীব মানুষ। সমালোচকদের একহাত নিয়ে মমতা বলেন, কেউ কেউ শুধু মিথ্যা প্রচার করছে। সারাদিন কুৎসা করছে। কিন্তু, তাতে লাভ হবেনা। আমি মানুষের জন্য কাজ করি। টাকা পেলে ঢেলে চাকরি দেব। এরপরই আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃনমূল কংগ্রেসকে জেতানোর ডাক দেন। পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ দিন। আরও ভালো ভালো কাজ হবে। এদিনের দুটি সভা থেকেই বর্ধমান জেলা ভাগের পক্ষে সওয়াল করেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া উপস্থিত ছিলেন, কৃষি মন্ত্রী মলয় ঘটক, ক্ষুদ্রকুটির শিল্প মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু, সাংসদ মুকুল রায়, জেলা শাসক ওঙ্কার সিং মিনা, পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা, আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দা ।